আতঙ্কে এক মাসেই আমানত কমেছে ১৩ হাজার কোটি টাকা
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে জানুয়ারিতে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। আর প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোতে কমেছে ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।
আলোচিত ব্যাংক একীভূতকরণ আতঙ্কে জানুয়ারি শেষে ব্যাংক খাতের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে আমানত ছিল ১৭ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের প্রথম মাসে আমানত কমেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্টাটিসটিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
সুদের হার বাড়ার পরও আমানত কমায় অবাক হয়েছে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা (মার্জার) করা নিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। মার্জার হলে ‘তাদের টাকার কী হবে?” সেই ভয়ে অনেকেই তাদের টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতের মোট আমানতের মধ্যে জানুয়ারি শেষে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৪ লাখ ২২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।
এ হিসাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে জানুয়ারিতে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। আর প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোতে কমেছে ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে আমানত কমেছে ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সুদ যোগ হয়ে সব সময় আমানতের স্থিতি বাড়ে। কিন্তু জানুয়ারিতে কেন কমল, তার সুনির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত জানানোর পর না বুঝে অনেকে টাকা তোলা শুরু করেন। মার্চে আনুষ্ঠানিক একীভূতকরণ শুরুর পর আতঙ্ক আরও বেড়েছে। হয়তো তারই প্রভাবে আমানত কমেছে।”
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “একীভূতকরণ নিয়ে অনেক আমানকারীদের মধ্যে ভয় রয়েছে। কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হয় এবং একীভূত হলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না এমন সন্দেহে অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছেন।”
“এছাড়া মূল্যস্ফীতি বাড়ায় বাড়তি টাকার প্রয়োজন হওয়ায় অনেক গ্রাহক তাদের ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গানোসহ অন্যান সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছেন। এটাও আমানত কমার একটি কারণ,” বলেন তিনি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার বেসিক ব্যাংক সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণায়ে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, গত ৮ এপ্রিল একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলনে গভীর সংকটে পড়েছে তারা।
“গত ৭ মে পর্যন্ত ব্যাংকটি থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা উত্তোলন হয়েছে। ফলে এসএলআর ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে অন্য উৎস থেকে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সিকিউরিটিজ লিয়েন রেখে টাকা ধার নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। অন্য ব্যাংকও তাদের কলমানি থেকে টাকা ধার দিচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে।”
এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের চেয়ারম্যানকে ডেকে জোর করে একীভূত হতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে মালিক হিসেবে সরকারের কাছে দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে আলোচনার মধ্যে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফেরাতে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৭ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই রোডম্যাপের আলোকে একীভূত বা মার্জার করার উদ্যোগ নিয়ে তো তোড়জোর শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
১৪ মার্চ দুর্বল পদ্মা ব্যাংক ও সবল এক্সিম ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সে সিদ্ধান্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতাও হয়।
এর পর গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। একীভূত করার কোনো সিদ্ধান্তই স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাধ্য করেছে।
কমেন্ট