সঞ্চয়পত্র: ৭ মাস ধরে কেনার চেয়ে ভাঙানো বেশি

সঞ্চয়পত্র: ৭ মাস ধরে কেনার চেয়ে ভাঙানো বেশি

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।

সঞ্চয়পত্রে মানুষের বিনিয়োগ কমছেই। গত সাত মাস ধরে সবচেয়ে নিরাপদ এই বিনিয়োগের নিট (প্রকৃত) বিক্রি নেতিবাচক বা ঋণাত্মক (-)। অর্থাৎ এই সাত মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সুদ-আসল পরিশোধে চলে গেছে। মানুষ এখন সঞ্চয়পত্র ভাঙাচ্ছেন বেশি, কিনছেন কম।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর গত বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা বেশি।

অথচ চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে এই খাতে বিনিয়োগ বেশ বেড়েছিল। প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক (-) ধারায় ফেরে; ওই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪৮ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। এর পর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাচেই নিট বিক্রি ঋণাত্মক (-) রয়েছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ যে কমবে, তা সরকার আগেই আন্দাজ করেছিল। সে জন্য চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল। ওই অর্থবছরের শেষে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই–মার্চ) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির ঋণাত্মক পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা।

এর মানে হচ্ছে—এই নয় মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ১২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে।

সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ির কারণে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশ কমে গিয়েছিল; বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল।

কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (গত বছরের জুলাই ও আগস্ট) বিক্রি বেশ ভালোই বাড়ছিল। সেপ্টেম্বরে এসে ফের ধাক্কা খায়।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’বা ‘ধার’হিসেবে গণ্য করা হয়।

তাহলে বলা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ‘ঋণ’বা ‘ধার’ নিতে পারেনি। উল্টো ১২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিতে হয়েছে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।

নানা ধরনের কড়াকড়ি, সুদের হার হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ে টান পড়ায় বিক্রি কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে কাঙ্খিত ঋণ পাচ্ছিল না সরকার। সে কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

কিন্তু অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধ এবং ভাঙ্গানো বাবদ ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা ঘটে। প্রতি অর্থবছর আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ এবং জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকরা মেয়াদ পূর্তির আগেই যে সব সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গান, সেই অর্থের পরিমাণ নতুন করে মোট যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি হয়।

কিন্তু গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার উল্টোটা হয়। ওই অর্থবছরে মোট বিক্রির চেয়ে সবকিছু শোধের পরিমাণ বেশি ছিল। সে কারণে গত অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারিনি।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে অতিমাত্রায় ব্যাংক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৮০ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর বিপরীতে সুদ-আসল পরিশোধ ও ভাঙ্গানো বাবদ মোট চলে যায় ৮৪ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এ হিসাবেই সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) হয়েছিল।

এর আগে ২০২১–২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছিল সরকার। ২০২০–২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকেকে বলেন, “সুদের হার বেশি হওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে বলছে। আইএমএফের পরামর্শে কয়েক দফায় সুদের হার বেশ খানিকটা কমানো হয়েছে। নানা ধরনের কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে। সে কারণেই গত অর্থবছরে প্রথম বারের মতো নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছিল।”

“এবার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুদিন ধরে সাড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠানামা করছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। মাঝে ১২ শতাংশের উপরে উঠেছিল। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক জরিপ করে বলেছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশ। মানুষ যা আয় করছে, তা নিয়ে সংসারই চলছে না। সঞ্চয় করবে কিভাবে? সঞ্চয়পত্র কিনবে কী দিয়ে?”

একই কথা বলেছেন আরেক অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

এআরএইচ ডট নিউজকেকে তিনি বলেন, “এখনও যে কোনো স্কিমের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। কোনো ঝামেলাও নেই; অনলাইন করায় প্রতি মাসের মুনাফা অটোমেটিক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। মেয়াদপূর্তির পর আসলও চলে আসে অ্যাকাউন্টে। তার পরও মানুষ আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনছে না; কিনছে না বললে ভুল হবে। কিনতে পারছে না। কেননা, বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে সন্তানদের শিক্ষা খরচ; চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।”

“অনেকে মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। সঞ্চয় করবে কিভাবে; সঞ্চয়পত্র কিনবে কি দিয়ে।”

‘তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমায় সরকারের একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে’ মন্তব্য করে আজিজুল ইসলাম বলেন, “এতে সরকারের ভবিষৎ ঋণের বোঝা কমবে।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।

সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকে বিক্রি কমতে থাকে।

গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরেছে সরকার।

কিন্তু অর্থবছরের নয় মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেনি সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেওয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৩ সালের মার্চে ছিল ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের এপ্রিল শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেওয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে।

৩০ ব্যাংক এমডির যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে আলোচনা পরবর্তী

৩০ ব্যাংক এমডির যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে আলোচনা

কমেন্ট