খেলাপি ঋণ পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়াল
জাতীয় বাজেট নিয়ে ডামাডোলের মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এই তথ্য দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যা ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় বাজেট নিয়ে ডামাডোলের মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এই তথ্য দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যা ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার।
ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা আর্থিক চিত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ।
দেশে এর আগে খেলাপি ঋণ বেড়ে কখনো এতটা হয়নি।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। পাশাপাশি খেলাপি হওয়া সুদ যুক্ত হওয়ার কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোতে তদারকি বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক কাজ করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে (সময়ে সরকারি–বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত—সব ধরনের ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মার্চে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা হয়েছে।
এ ছাড়া সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসির (বিডিবিপি) খেলাপি ঋণ ৮৭৩ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ খেলাপি ছিল, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঋণখেলাপি ছিল, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ ঋণখেলাপি ছিল, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক—বিশেষায়িত এই দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, খেলাপি ঋণের হার ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের লাগাম পরানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, সাবেক ও বর্তমান আমলাদের পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়োজিত পর্যবেক্ষকও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না। ফলে তিন মাসে খেলাপি ঋণ এত পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন এআরএইচ ডটকমে বলেন, “খেলাপি ঋণের এই চিত্র সত্যিই উদ্বেগজনক। ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার কারণেই এটা হয়েছে। যে করেই হোক এটাকে কমাতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে; শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তানাহলে আমাদের গেড়াটা অর্থনীতিকেই এর মাশুল দিতে হবে।”
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হলো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমানো। ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। তবে উল্টো এখন খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের প্রায় সবাই সরকারের ঘনিষ্ঠ ও বিভিন্ন পদে রয়েছেন। তাদের ঋণগুলো তদারকির বাইরে থেকে যাচ্ছে। আগে ভালো ছিল, এমন কিছু ঋণও এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। খেলাপি চিহ্নিত করার নতুন নিয়মের কারণে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে তারা মনে করেন।
যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকেরা। ২০২২ সালে এসব নীতি ছাড় তুলে দেওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকেই।
এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই একজন গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব ঋণ গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে থাকার সুযোগ পান। এই সুবিধা দেওয়া হয় শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেকেই মেয়াদি ঋণ।
এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি কেবল বাড়ছেই; বরং বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।
এদিকে গত বছর জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি
মূলত ২০১৫ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টম্বর) ব্যাংক খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে; যা ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৮ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ।
বিশাল অঙ্কের এই ঋণ খেলাপি নিয়ে সবচেয়ে জোরালো কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “আজ ব্যাংকিং খাতের যে দুরাবস্থা তার জন্য খেলাপি ঋণ দায়ি: বড় বড় ঋণ খেলাপিরা দায়ি। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকিং খাতে কখনই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না।”
“বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন (রাইট অফ) করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন।
“কিন্তু কোনো সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। তাহলে হয়তো এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।”
কমেন্ট