মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে আসছে নতুন মুদ্রানীতি

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে আসছে নতুন মুদ্রানীতি

সরকারের রাজস্ব নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বছরে দুইবার মুদ্রানীতির ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ বাড়ানো বা কমানোর নীতি বা বিভিন্ন নির্দেশনার কথা তুলে ধরা হয়।

১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় নতুন মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম।

এর আগে গত ১০ জুলাই মুদ্রানীতি নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, আগের মুদ্রানীতিগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারের মুদ্রানীতিও সংকুলানমুখী ভঙ্গি নিয়ে এগোবে।

এ ছাড়া মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে জানিয়ে ওই বৈঠকে গভর্নর বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্ব নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মুদ্রানীতিও সংকোচনমূলক রাখা হবে।

আগের মতো সংকোচনমুখী পদক্ষেপ নিয়ে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হবে, নীতি সুদের হার বাড়ানো ও টাকার সরবরাহ কমানো, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

গত মে মাসে সুদহার বাজারভিত্তিক করার পর এরই মধ্যে তা ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে ১১৮ টাকায় উঠেছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। সে জন্য নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হতে পারে। পাশাপাশি নেওয়া হতে পারে নতুন উদ্যোগ।

এদিকে অন্যান্যবার মুদ্রানীতির ঘোষণা দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এবার সে ধরনের কোনও আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ কর্মীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের কারণে ইতোমধ্যে সংস্থাটির একটি সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেন সংবাদকর্মীরা। এবার মুদ্রানীতির অনুষ্ঠান বর্জনের আশঙ্কা থেকে সংবাদ সম্মেলনের বিকল্প হিসেবে মুদ্রানীতির বিবরণী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তুলে ধরবে সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হবে।

সরকারের রাজস্ব নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বছরে দুইবার মুদ্রানীতির ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ বাড়ানো বা কমানোর নীতি বা বিভিন্ন নির্দেশনার কথা তুলে ধরা হয়, যা থেকে অর্থনীতির ভবিষ্যত ধারা সম্পর্কে ইঙ্গিত পায় বেসরকারি খাতের ‍উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা।

নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এই অর্থবছরে সরকার মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে। গত ৩০ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে।

এর আগেও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মুদ্রানীতি ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফজলে কবির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে পরপর দুই বছর মুদ্রানীতি ঘোষণার জন্য কোনও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়নি।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কারণে মুদ্রানীতির বিবরণী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এবং প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া আগে প্রতি ছয় মাসে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও ওই দুই বছর ১২ মাসে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়।

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত জুনের শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এ জন্য ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংককে ঠিকই টাকা ছাপিয়ে বিশেষ ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে মুদ্রা সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছর নীতি সুদহার দুই দফা বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের ব্যাংকঋণের সুদে। ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ঋণগ্রহীতাদের ওপর। তাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এভাবে অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেই চেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।

সরকার চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এরই মধ্যে সরকারি ঋণের ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশে ও বন্ডের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহারের মাধ্যমে ব্যাংকের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এখন নীতি সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরো অঞ্চল ও ভারতের মতো বাংলাদেশেও ২০২১ সালের জুন মাসের পর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার দিকে লক্ষ্য রেখে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকেই নীতি সুদহার বাড়াতে থাকে।

বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিটি দেশই দ্রুত নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ করেছে ধীরগতিতে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দ্রুত অধিক হারে নীতি সুদহার ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমে নীতি সুদহারের কাছাকাছি আসা কিংবা আরও নিচে না নামা পর্যন্ত নীতি সুদহারের লাগাম টেনেছে।

একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে খুবই ধীরগতিতে। গত বছরের জুলাইয়ে ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা প্রত্যাহারের পর থেকে নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক ধাপ বাড়ানোর পর তারা থেমে যায়, পরে আবার বাড়ায়।

ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। আসছে নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা পদক্ষেপ নিতে পারবে, এটাই এখন দেখার বিষয়।

মোবাইলে আর্থিক সেবার গ্রাহক এখন ২৩ কোটি পরবর্তী

মোবাইলে আর্থিক সেবার গ্রাহক এখন ২৩ কোটি

কমেন্ট