রেমিটেন্স কমায় খোলাবাজারে ডলার ১২৪ টাকা
গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খোলাবাজারে ডলারের দর বেড়ে ১২৬ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর ৮ মে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর আগ পর্যন্ত ডলারের দর ১২১ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে উঠানাম করে।
ডলারের বাজার ফের অস্থির হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার একদিনেই খোলাবাজারে ডলারের দর আড়াই টাকা বেড়ে ১২৪ টাকায় উঠেছে। এদিন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকগুলোও নগদ ডলারসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকা দরে ডলার লেনদেন করেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ কমার খবরে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাটির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খোলাবাজারে ডলারের দর বেড়ে ১২৬ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর ৮ মে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর আগ পর্যন্ত ডলারের দর ১২১ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে উঠানাম করে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ১২০ টাকার নিচে নেমে আসে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংস পরিস্থিতির আগ পর্যন্ত ১২০ টাকার নিচেই ছিল ডলারের দর। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার খোলাবাজারে ডলারের দর বেড়ে ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে; সোমবারও এই দরে বিক্রি হয়। মঙ্গলবার তা বেড়ে ১২৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে। এর মাধ্যমে এক লাফে প্রতি ডলারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঘোষণা করা হয় ১১৭ টাকা। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের দর নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি মানিচেঞ্জারের কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মঙ্গলবার আমরা ১২৩ টাকা ৫০ থেকে ৬০ পয়সায় ডলার কিনেছি। বিক্রি করেছি ১২৪ টাকা। সোমবার বিক্রি করেছিলাম ১২১ টাকা ৫০ পয়সায়।”
হটাৎ কেন দাম বাড়ল- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। তাই দাম বাড়ছে। রেমিটেন্স কমে গেছে- এ খবর সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে যাদের হাতে ডলার আছে, আরও দাম বাড়বে- সে আশায় তারা বিক্রি করছে না। তাই দাম বাড়ছে।”
মঙ্গলবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ১১৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও একই দর নিয়েছে। অন্য সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সব ক্ষেত্রে ডলারের দর নিয়েছে ১১৮ টাকা।
আন্দোলনের আগে ব্যাংকগুলোতে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকার মধ্যে ডলার কেনোবেচা হয়।
কোটা আন্দোলনের ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্সে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ২৭ দিনে (১ থেকে ২৭ জুলাই) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫৬ কোটি ৭৫ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৮ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ৬৮৫ কোটি টাকা।
মাসের বাকি চার দিনে (২৮ থেকে ৩১ জুলাই) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ১৮০ কোটি (১.৮০ বিলিয়ন) ডলার হবে, যা হবে ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর পরের নয় মাসের পাঁচ মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে; চার মাস এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি নিয়ে শুরু হয় নতুন অর্থবছর। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে রেমিটেন্স প্রবাহে আরও পতন দেখা দিয়েছে। যদিও আগের মাস জুনে এই সূচকে উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল।
গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার; টাকার হিসাবে ছিল এক হাজার কোটি টাকা।
একক মাসের হিসাবে জুন মাসের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা। গত বছরের জুনের চেয়ে এই বছরের জুনে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি এসেছিল দেশে।
তার আগে মে মাসেও ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, ১২৫ কোটি ৪৯ লাখ (১.২৫ বিলিয়ন) ডলার।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে এই ধরনের প্রচারে বিভ্রান্ত না হতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলেছে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ওই দিন লেনদেন চলে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা।
ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় আসাও সম্ভব ছিল না। এ সময়ের মধ্যে যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, ২৪ জুলাইয়ের পর তা দেশে এসেছে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামে; আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
এর পরের নয় মাসের পাঁচ মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে; চার মাস এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার এসেছিল দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অর্থবছরের হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।
পাঁচ বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এক লাফে ৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
পরের অর্থবছরে (২০২১-২২) অবশ্য তা কমে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসে একটু বেশি, ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট