‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক: সিপিডি

‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক: সিপিডি

সোমবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশ তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

দেশের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের বেশ কয়েকটি ব্যাংক ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ হয়ে পড়েছে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। জনগণের অর্থে পুঁজি পুনর্ভরণ করে এই ব্যাংকগুলোকে আর কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে নয় সংস্থাটি।

সোমবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশ তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

তিনি বলেন, “এই ব্যাংকগুলোর চলনশক্তি আর নেই। এগুলো ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছে। এগুলো পূনর্ভরণ করে পুঁজি যোগান দিয়ে সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই বেঁচে থাকার মতো অবস্থায় নেই। তারপরও এগুলো বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি অর্থ, জনগণের অর্থ খরচ হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হয়ে যাক, প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যু হয়ে যাক, এটাই আমরা বলছি।”

এছাড়া কিছু ব্যাংক এখনও মৃতপ্রায় না হলেও ঢিমেতালে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “সেগুলোকে যদি চালানোর ইচ্ছা থাকে, তাহলে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি পরিবর্তন করে আরেকবার চেষ্টা করা যেতে পারে।”

এ ধরনের ব্যাংকের সংখ্যা না বললেও ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকগুলোর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী- ১১টি ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন হারে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। একসময়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ভালো ব্যাংক ছিল। এটিকে দখলের পরে সেটিও মুমূর্ষু হয়ে গেছে।

দেশের ব্যাংক খাত এতদিন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে এমন অভিযোগও করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, গুটিকয়েক গোষ্ঠীর জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করা হতো। সেই নিয়মনীতি আবার ওই গোষ্ঠীগুলোই ঠিক করে দিত।

গত এক দশকের বেশি সময়ে ব্যাংকিং খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকার বেশি ঋণ বেহাত হয়েছে।

ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের লক্ষ্যে তিন মাসের জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ব্যাংক খাতের অশুভ আঁতাত ভেঙে ফেলতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বসাশন ফিরিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) বন্ধ করে দেওয়ারও সুপারিশ করেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পৃথিবীর সব দেশেই তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে। সেখানে কি আলাদা কোনো সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে? আমাদের দেশে তো এফআইডি আমরা তুলে দিয়েছিলাম। যদি আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্বাধীনতা দিতে পারি এবং স্বায়ত্বশাসন বজায় রাখতে পারি এবং সে যদি সংসদের কাছে তার জবাবদিহি করে, তাহলে এরকম দ্বৈতশাসন দরকার হয় না।”

এফআইডির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় অভিযোগ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এটা যে কিভাবে নিয়ম-কানুন না মেনে করা হয় সেটা তো আমরা দেখেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমরা যদি শক্তিশালী করতে পারি, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পারি, তাহলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এফআইডি না থাকলেও আমরা এটা করতে পারব।”

স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তার সব দিক সামাল দিতে পারবে বলেও মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তার মতে এফআইডি বিভাগটি বিলুপ্ত করার সময় এসেছে। এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মত তার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে জারি করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তার সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারত।

সিপিডির অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের জন্যই এফআইডি গঠন করা হয়েছিল।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, “অর্থনৈতিক অবদানে সহযোগিতার জন্য ব্যাংকিং খাতকে বিশদ কাঠামোগত সংস্কার করা দরকার। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। যা আমরা অতীতে দেখতে পাইনি। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষন না করে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নররা যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছেন সেগুলো ব্যাংকিং আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব ভালো চর্চাগুলো ছিল সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অথবা নতুন নিয়ম তৈরি করে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছেন তারা। এই অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে গিয়েছে।

“এর প্রত্যেকটি ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিৎ এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।”

পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের মধ্যে যাদের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতার ঘাটতি আছে তাদেরকেও পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

কিছুদিন আগের ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগকে আরও সুগঠিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জের দিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি মনে করে, জোর জবরদস্তি করে নয় বরং একীভূত করার পূর্বশর্তগুলো পূরণের মাধ্যমে কাজ করতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, “একটি ভালো ব্যাংক কেন দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তার নিজেরও তো অনেকগুলো ঝুঁকি রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করে তারপর মার্জ করতে হবে। সারা পৃথিবীতেই মার্জ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো সফল হয়। কিন্তু মার্জ সফল হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকের সঠিক মূল্যায়ন করা।”

বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এত ব্যাংক প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ফাহমিদা খাতুন। এত ব্যাংকের লাইসেন্স কেন দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলন থেকে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে রাজনীতিমুক্ত করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সুনামের ওপর ভিত্তি করে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সরকার পতনের ধাক্কা ব্যাংকগুলোতে পরবর্তী

সরকার পতনের ধাক্কা ব্যাংকগুলোতে

কমেন্ট