ব্যাংক কমিশন গঠনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
এ ছাড়া আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে।
আর্থিক খাত স্থিতিশীল ও সংস্কার এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাতে টেকসই সংস্কারের জন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠন।
এ ছাড়া আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে।
রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এতে জানানো হয়, সভায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যান্ড ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। বিনিময় হার নির্ধারণের ক্রলিং পেগ ব্যবস্থায় বর্তমানে ডলারের মধ্যবর্তীর দাম ১১৭ টাকা, যা ১১৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ডলারের দাম ১২০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারবে। এতে খুব দ্রুতই আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য ফিরে আসবে এবং বিনিময়ের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বলা হয়, চাহিদা ও জোগানের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক অবস্থায় ধরে রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি পেতে সবাইকে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত জুলাই মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই মাসে বেড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছে। যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এরপর আর কখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে ওঠেনি।
ছাত্র-গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেও মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানো বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার গঠনের ১০ দিনের মাথায় প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে এটিকে সামাল দেওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে, কর্মপন্থাও ঠিক করার তথ্যও দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এজন্য মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক অবস্থায় ধরে রাখতে হবে এবং একইসাথে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাই এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে।”
ব্যাংক খাত সংস্কার সম্পর্কে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নরের বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় এ খাতে সংস্কারের বিষয়টি চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে টেকসই সংস্কার করার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
এ ছাড়া আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে; যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।
এর আগে গত বুধবার (১৪ আগস্ট) আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডলারের সরবরাহ কীভাবে বাড়ানো যাবে, সে বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কাজ করবে।
ব্যাংক খাতে অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যাংকিং কমিশনের বিষয়টিও সামনে এসেছিল সেদিন। তখন তিনি বলেছিলেন, “ব্যাংকিং কমিশন কিংবা টাস্কফোর্স যাই গঠন করা হোক, দুর্বল ব্যাংকগুলোতে অডিট করতে হবে। এটা নিয়ে একটা টাস্কফোর্স কিংবা কমিশন দিয়ে কাজ করতে হবে।
“যেসব দুর্বল ব্যাংক আছে, তাদের সবার অডিট করতে হবে। তাদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কী রকম সাহায্য দেওয়া হবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা হবে। এছড়া মালিকানা পরিবর্তনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটাও নির্ধারণ হবে অডিটের মাধ্যমে।”
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও ব্যাংক কমিশনে গঠনের বিষয়টি অনেকবার সামনে এসেছিল। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের একের পর এক অভিযোগের মধ্যেও কমিশন গঠনের বিষয়টি প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়।
জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৪ জুন বলেছিলেন, “ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
এর আগে ২০১৬ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রায়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ব্যাংক খাতকে আরও বেশি নজরদারির মধ্যে আনতে একটি কমিশন গঠনে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এরপর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, ওই কমিশন তিনি গঠন করবেন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকারের শেষ বছরের বাজেট দিয়ে তিনি বলেন, ওই মেয়াদে আর ব্যাংক কমিশন হচ্ছে না।
ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে তিন মাসের জন্য জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার সুপারিশ করে সবশেষ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলেছে, “এ খাতে ‘দ্বৈত প্রশাসন’ কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করতে হবে। এ বিভাগের জন্য সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই।”
সরকার পতনের পর গত ১২ অগাস্ট ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের দুষ্টু চক্র ভেঙে ফেলতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
কমেন্ট