খেলাপি ঋণ ছাড়াল ২ লাখ কোটি টাকা
গত জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ছয় মাসে বেড়েছে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ছয় মাসে বেড়েছে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা।
মঙ্গলবার ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এই তথ্য দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যা ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার।
ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা আর্থিক চিত্রে অনেক আগে থেকেই ফুটে উঠতে শুরু করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তিন মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা; যা ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। যা ছির ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ।
তিন মাস পর পর (প্রান্তিক) খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তথ্যে দেখা যায়, সবশেষ এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সরকারি–বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত—সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
গত জুন শেষে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৯ শতাংশ ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ ব্যাংকে। এই ব্যাংকগুলো হলো—সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভোলপমেন্ট ব্যাংক। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের ৪৭ শতাংশ ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে ব্যাংক আছে ৪৩টি।
এছাড়া বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে খেলাপি ঋণের প্রায় ৩ শতাংশ। এই ব্যাংক দুটি হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। এই ব্যাংক দুটিতে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
বাকি এক শতাংশ খেলাপি ঋণ বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। বিদেশি খাতে ব্যাংক আছে ৯টি।
খেলাপি ঋণ গোপন করার সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে আগের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকার পতনের আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে গত মার্চ থেকে কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ কমে এসেছে।
আবার তদারকি শিথিলতার কারণে এতদিন জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আর ফেরত আসছে না। সরকার পতনের পর এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ঘরনার ব্যবসায়ীদের অনেকেই পালিয়েছেন। এতে করে খেলাপি ঋণ আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।
আইএমএফের ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তাদের শর্ত মেনে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর কথা। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে এখনকার মতো নীতি সহায়তা রাখা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “খেলাপি ঋণের এই চিত্র সত্যিই উদ্বেগজনক। ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার কারণেই এটা হয়েছে। যে করেই হোক এটাকে কমাতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে; শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তানাহলে আমাদের গোটা অর্থনীতিকেই এর মাশুল দিতে হবে।”
“তবে এখন নতুন সরকার এসেছে। নতুন গভর্নর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন। আশা করছি সুফল পাওয়া যাবে।”
যেভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকেরা। ২০২২ সালে এসব নীতি ছাড় তুলে দেওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকেই।
এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই একজন গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব ঋণ গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে থাকার সুযোগ পান। এই সুবিধা দেওয়া হয় শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেকেই মেয়াদি ঋণ।
এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি কেবল বাড়ছেই; বরং বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।
এদিকে গত বছর জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি
মূলত ২০১৫ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টম্বর) ব্যাংক খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে; যা ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৮ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ।
বিশাল অঙ্কের এই ঋণ খেলাপি নিয়ে সবচেয়ে জোরালো কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “আজ ব্যাংকিং খাতের যে দুরাবস্থা তার জন্য খেলাপি ঋণ দায়ি: বড় বড় ঋণ খেলাপিরা দায়ি। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকিং খাতে কখনই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না।”
“বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন (রাইট অফ) করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
“যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন।
“কিন্তু কোনো সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। তাহলে হয়তো এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।”
“আশা করছি, অন্তবর্তী সরকার এক্ষত্রে কঠোর অবস্থান নেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনবে; সুশাসন নিশ্চিত করবে।”
কমেন্ট