আমানত ফেরত দিতে ধার পাবে দুর্বল ব্যাংকগুলো
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকার্স সভার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
নগদ টাকার সঙ্কট থাকায় সাত-আটটি ব্যাংকের আমানতকারীরা চাহিদামতো তাদের অর্থ তুলতে পারছে না। মাস খানেক ধরে এ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোকে তারল্য জোগান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই আমানতকারীরা যাতে সীমিত আকারে হলেও টাকা তুলতে পারে, সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ধার করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘গ্যারান্টর’ হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, “আমরা চেষ্টা করছি আমানতকারীদের এই সঙ্কট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি (রিলিফ) দিতে। পুরোটা দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ সেই পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলোর হাতে নেই।”
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকার্স সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন গভর্নর আহসান মনসুর। সভায় বিভিন্ন ব্যাংকের নির্বাহীর সঙ্গে ব্যাংক খাতের সমসায়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়।
গভর্নর বলেন, “আমরা এই বিষয়টি (তারল্য সঙ্কট) নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি। ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বিভিন্নভাবে পাচার করা হয়েছে। আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটা প্রধানত ৭-৮টি ব্যাংকের মধ্যে সীমিত আছে। এই ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সঙ্কটের মধ্যে আছে।”
গ্রাহকদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা গেছে, চাহিদামতো আমানত তুলতে না পারার ঘটনা বেশি ঘটছে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে। এই ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন শাখায় চেক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেও চাহিদামতো টাকা তুলতে পারেনি গ্রাহকরা। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ সংক্রান্ত অভিযোগ বেশি পাওয়া গেছে।
ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল এসব ব্যাংক। ঋণ অনিয়মের কারণে আস্থা সঙ্কট দেখা ছিল এসব ব্যাংক নিয়ে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে সরকার পতন হলে এস আলমের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ব্যাংকগুলো। এরপর পুরনো আস্থা সঙ্কটের সঙ্গে আতঙ্ক যোগ হয় ব্যাংকগুলো নিয়ে; টাকা তুলে নিতে শুরু করে আমানতকারীরা।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ ছাড়েন আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন গভর্নর করা হয় আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। এজন্য সময় লাগবে বলেও জানান তিনি।
গভর্নরের দায়িত্বে নিয়ে আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “বেআইনিভাবে কোনও দুর্বল ব্যাংককে আর তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।”
এর মধ্যেই আতঙ্কিত হয়ে টাকা তোলা শুরু হলে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলা সীমিত করে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৮ আগস্ট নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ তোলা যেত এক লাখ টাকা। এরপর আস্তে আস্তে টাকা তোলার সীমা বাড়ানো হয়।
গত সপ্তাহে দিনে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সীমা ছিল ৪ লাখ। চলতি সপ্তাহে সেই সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
অথচ আমানতকারীরা বলছেন, এই ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ২০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা। মোবাইল অ্যাপ এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবাও সীমিত করে রাখা হয়েছে এসব ব্যাংকে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক উভয় সঙ্কটে পড়েছে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানান গভর্নর।
আহসান মনসুর বলেন, “আমরাও উভয় সঙ্কটে আছি। আমরা যদি সকল ব্যাংককে বেইলআউট করতে যাই, তাহলে হয়তো দুই লাখ কোটি টাকা লাগবে। এই টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দিলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।
“বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার হয়তো ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি হয়তো ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এটা আমাদের কাম্য নয়। কাজেই আমাদের মুদ্রানীতির ব্যবস্থাপনা ঠিক রেখে সীমিত আকারে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেব।”
“আমরা চেষ্টা করছি, এই ব্যাংকগুলো যাতে আন্তঃব্যাংক মার্কেট থেকে টাকা ধার করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার থাকবে। কেননা, এই ব্যাংকগুলোকে এখন কোনও ব্যাংক ধার দেবে না,” যোগ করেন তিনি।
এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের পুরো টাকা ফেরত দিতে পারবে না জানিয়ে গভর্নর বলেন, “এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবে না। তাদেরকে (আমানতকারীদের) একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
তিনি বলেন, সমস্যাগুলো অনেক দিনের। এটা আমানতকারীরাও জানত। তারপরও তারা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ওই ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখেছে।
এ কারণে ব্যাংকগুলোর মালিকরাও টাকা বেশি আত্মসাৎ করতে পেরেছে বলে মনে করেন গভর্নর মনসুর।
তিনি বলেন, “তারপরও আমরা আমানতকারীদের স্বার্থ দেখব। যাতে তারা ব্যাংক থেকে অল্প অল্প করে টাকা তুলে তাদের পারিবারিক খরচ চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত আমরা বড় বড় ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে দ্রুত বাংলাদেশের ভেতরে তাদের যেসব সম্পদ আছে সেগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করব। তৃতীয়ত বিদেশে তাদের যেসব সম্পদ আছে সেগুলো উদ্ধার করার জন্য আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহযোগিতা নেব।”
যুক্তরাজ্যেই একজনের ৬০০ বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ সম্পর্কে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা বড় ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের দেশে থাকা সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছি। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে চেষ্টা চলছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সামনে আরও আলোচনা হবে। আমরা অর্থ ফেরত আনতে ও কারিগরি সহায়তা দিতে তাদের আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা জব্দের জন্য বলছি।”
গভর্নর বলেন, কেবল যুক্তরাজ্যেই একজনের ৫০০-৬০০ বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। আরও অনেকের এমন সম্পদ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বড় গন্তব্য যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব অর্থ ফেরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেখা যাক কী হয়।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর অর্ধেক টাকা নাই হয়ে গেছে
ব্যাংকগুলোর অবস্থা উন্নয়নে পর্ষদে পরিবর্তন আনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আসবে। এসব ব্যাংকে নিরীক্ষা করা হবে। এরপর ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এসব ব্যাংক পুনর্গঠন করে একা চলবে, না কি কারও সঙ্গে একীভূত হবে- সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হবে। ছোট ব্যাংক হলে অবসায়নও হতে পারে।
গভর্নর বলেন, “ইসলামী ব্যাংকগুলোর অর্ধেক টাকা নাই হয়ে গেছে। ১-২ বছর সময় লাগবে এসব ব্যাংক মেরামত করতে।”
পাচারকৃত অর্থ পুরোপুরি না পারলেও আংশিকভাবে ফেরত আনা সম্ভব বলে আশা করছেন গভর্নর। তিনি বলেন, “এই টাকা ফেরত আনতে ২-৩ বছর সময় লাগবে।”
ব্যাংক খাতের উন্নয়নে তিন টাস্কফোর্স
সভা শেষে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সঙ্কট দূর করার জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা জানিয়েছেন গভর্নর। আমরা আশা করি, এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।”
সেলিম এফ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি উন্নয়নে খেলাপির দিক থেকে নন-পারফর্মিং লোন ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট ও লিগ্যাল ফ্রের্মওয়ার্ক-এই তিন ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
টাস্কফোর্স তিনটি গঠনে কত সময় লাগবে, তা এখনও ঠিক করা হয়নি জানিয়ে সেলিম বলেন, “এসব টাস্কফোর্সে দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে এক্সপার্টদের রাখা হবে। এই টাস্কফোর্স হবে আন্তর্জাতিক মানের। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ থেকেও এক্সপার্ট আসতে পারেন।”
ডলারের বাজার এখন স্থিতিশীল
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গভর্নর চান বাজারভিত্তিক সুদের হার। তিনি চান বাজারকে প্রভাবিক না করে ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করতে, তাতে বাজার স্থিতিশীল হবে।
“লিবারেল ইন্টারেস্ট রেট রেজিমে গভর্নর বিশ্বাস করেন। উনি ইন্টারেস্ট রেট ফ্রি ফ্লোট করে দিয়েছেন। ল্যান্ডিং রেটে অলিখিত কিছু ক্যাপ ছিল, তিনি তাও তুলে দিয়েছেন। ব্যাংকারদের নির্দেশনা দিয়েছেন, আনইউজুয়াল কোনো ল্যান্ডিং রেটে যেন তারা না যান।”
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের মে মাসে বৈদেশিক মুদ্রার দর নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে। তাতে ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়। ‘ক্রলিং পেগ’ অনুসারে বর্তমানে ডলার দর ১২০ টাকা।
গভর্নর এই দরের মধ্যেই সব ব্যাংককে ব্যবসা পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান এবিবি চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, "এক্সচেঞ্জ রেট এখন ১২০ টাকার মধ্যে রয়েছে। আমরা এই রেটেই ব্যবসা পরিচালনা করব। কার্ব মার্কেটে (অপ্রচলিত বাজার) ডলারের দাম ১২১ থেকে ১২২ টাকায় রয়েছে। ডলার মার্কেটে এখন স্ট্যাবিলিটি এসেছে। এই মাসে আমরা আড়াই বিলিয়নের বেশি রেমিট্যান্স পাব বলে আশা করছি।”
এলসি খোলায় এখন আর সমস্য নেই
এলসি খোলায় এখন আর সমস্য নেই বলে মন্তব্য করেন সেলিম বলেন, “এলসি ওপেনিং স্লো-ডাউন হয়েছে, এটা অনেকটা কনজাম্পশনের ওপর নির্ভর করে। ডিমান্ডও অনেক কমে গেছে। মার্কেটে এখন ডলারের কোনো অভাব নেই, যার যখন প্রয়োজন এলসি খুলতে পারছে।”
রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ডলারের অভাবে অনেক পেমেন্ট আটকে আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সেসব পেমেন্টের সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছেন এবিবি চেয়ারম্যান।
সেলিম বলেন, "আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ- সরকারি চারটি ব্যাংকে দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট আটকে আছে। আমরা আশা করছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই পেমেন্টগুলো সম্পন্ন হবে। তাতে মার্কেটে যে চাপটা এখন আছে, তা রিজলভড হয়ে যাবে।"
বাংলাদেশ ব্যাংক ততক্ষণ পলিসি রেট বাড়াবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। গভর্নরের কাছ থেকে এ রকমই আভাস পাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
সেলিম বলেন, "পলিসি রেট ততক্ষণ বাড়তে থাকবে, যতক্ষণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে পলিসি রেট ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়া।"
কমেন্ট