মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার আরও বাড়ছে

মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার আরও বাড়ছে

সবশেষ এক মাস আগে গত ২৫ অগাস্ট ‘নীতি সুদহার’ হিসেবে পরিচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সিদ্ধান্তের ফলে এখন নীতি সুদহার ৯ শতাংশে রয়েছে।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ নামাতে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, “আগস্টে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমলেও সাড়ে ১০ শতাংশে অবস্থান করছে। এতে মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আর সেজন্য এই সূচক কমানোর অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে নীতি সুদহার আরও বাড়নো হবে। চলতি সপ্তাহেই এক দফা বাড়ানো হবে। আগামী মাসে আরেক দফা বাড়ানো হবে।”

সবশেষ এক মাস আগে গত ২৫ অগাস্ট ‘নীতি সুদহার’ হিসেবে পরিচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সিদ্ধান্তের ফলে এখন নীতি সুদহার ৯ শতাংশে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।

সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সবশেষ গত ২৫ অগাস্ট ‘নীতি সুদহার’ হিসেবে পরিচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সিদ্ধান্তের ফলে এখন নীতি সুদহার ৯ শতাংশে রয়েছে।

এর আগে ৮ মে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

আগস্টে তা কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে।

আগস্ট মাসে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো—গত বছরের আগস্ট মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের আগস্টে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৪৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, “আমি আশাবাদী, মূল্যস্ফীতি মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে একটি ভালো জায়গায় চলে আসবে। কতখানি ভালো জায়গায় আসবে সেটা হয়ত বলা যাবে না। তবে আমরা পলিসি টাইট করব, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে।

“আমাদের এখন বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে। এছাড়া রেমিটেন্সও বাড়ছে। আশা করি আগামীতেও বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। যদি এটা ধরে রাখা যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি অবশ্যেই কমে আসবে।

“তাছাড়া আমাদের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্য রাখা হয়েছে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা কমানো হতে পারে। এটা হলে বেসরকারি বিনিয়োগও ঠিক হয়ে আসবে। সবমিলিয়ে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে সুদের হার আমরা কমিয়ে আনতে পারব। সে জন্য সময় দিতে হবে।”

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মূলত নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। বিষয়টি হলো এমন—কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে সেই দেশের মানুষের হাতে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সেই বাড়তি অর্থের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমূখী হয়, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে তারা।

নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো—ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহার বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। নীতি সুদহার হলো রেপো।

এর সঙ্গে রিভার্স রেপো রেটের আলোচনাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নিতে পারে। এই তুলে নেওয়ার জন্য সুদের নির্দিষ্ট হার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে সুদ দেয়, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।

ছোট ব্যাংক একীভূত করা হবে

ইসলামী ধারার ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা চিন্তা আছে বলে জানান দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আলোচিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ইসলামী ব্যাংক একীভূত করা হবে কিনা জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, “ছোট ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার চিন্তা আছে। ব্যাংক সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারলে ভালো হবে।”

তিনি বলেন, “একীভূত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এখানো কোনো সিদ্ধান্তে যায়নি। আমরা চেষ্টা করব ছোট ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে ফেলা যায় কিনা। এসব ব্যাংকগুলোতে যেহেতু মূলধন সহায়তা আমরাই করব, সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।

“কারণ অনেকগুলো ব্যাংকের আগের মালিকরা অনিয়ম করে তাদের মালিকানা হারিয়েছেন। এখন ওই মালিকানা সরকারের ক্ষেত্রে একীভূত করা সহজ হবে। তবে বাস্তবতা বুঝে আমরা কাজ করব। এক্ষেত্রে ব্যাংক একীভূত হলেও আমানতকারীদের টাকা ফেরৎ দেওয়া হবে।”

যেভাবে কাজ করবে টাস্কফোর্স

ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কীভাবে কাজ করবে তা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন আহসান মনসুর। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ব্যাংক খাত সংস্কারে গত ১১ সেপ্টেম্বর ছয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গভর্নর বলেন, “টাস্কফোর্স মূলত ৩টি বিষয়ে কাজ করবে। প্রথমত, ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ নির্ণয় করবে। এরপর ব্যাংকগুলোর সম্পদ কোথায় আছে তা চিহ্নিত করবে। এরপর ওই সম্পদ পুনরুদ্ধারে কাজ করবে।

“আমরা প্রথমে তিনটি ব্যাংক নিয়ে কাজ করব। পরবর্তীতে আরও ছয়টি ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৪ জন কর্মকর্তাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে দুই গ্রুপে চার জন করে কর্মকর্তা দিবেন। আর অন্য গ্রুপে রয়েছেন ৬ জন।

“এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বড় হওয়ায় পরির্দশনের দায়িত্বে থাকবেন ৬ জন কর্মকর্তা। পাশাপাশি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি নিরীক্ষকদেরও যুক্ত করা হবে। উন্নয়ন সহযোগীরা এসব অর্থ দিবে।”

তিনি বলেন, “আমরা প্রথমে দেখব ব্যাংক থেকে নামে বা বেনামে কী পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। এরপর ওই অর্থ যদি দেশের বাইরে চলে যায় তাহলে সেগুলো কীভাবে আন্তর্জাতিক আইন মেনে আনা যায় সে বিষয়ে কাজ করব। এ ক্ষেত্রে আমরা বড় কেসগুলোকে নিয়ে কাজ করব। আমাদের যদি ৪ লাখ কোটি টাকার মতো খারাপ সম্পদ থেকে থাকে তার অর্ধেক হয়ে তো অল্প কয়েকজন ব্যক্তির কাছে গেছে। এজন্য তাদের উপর বেশি ফোকাস থাকবে। আর ছোটগুলো সিস্টেমেটিক ওয়েতে তুলে আনা হবে।”

তারল্য সহায়তা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে সেগুলো রেমিটেন্সের ওপর ভর করে ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন গভর্নর আহসান মনসুর।

“আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। যদি এসব ব্যাংক রেমিটেন্স ভালো পায়, তাহলে তাদের তারল্য প্রবাহ বাড়ায় সহায়তা করবে। রেমিটেন্স যখন তারা বিক্রি করবে তখন তাদের হাতে টাকা চলে আসবে। এভাবেই তারা রিকভার করতে পারবে।”

দুর্বল ব্যাংকগুলোতে তারল্য সহায়তা দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কিছু ব্যাংক থেকে গ্রাহক টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখছে। যেসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলা হচ্ছে তারা তারল্য সংকটে পড়ছে। আবার যাদের কাছে রাখা হচ্ছে তাদের তারল্য বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য আমরা গ্যারান্টার হয়ে তারল্য বেশি থাকা ব্যাংকগুলো থেকে কম থাকা ব্যাংকগুলোকে টাকা দিব।

“এক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংক টাকা না দিতে পারলে ওই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিশোধ করবে। এখন পর্যন্ত এই স্কিম থেকে কাউকেই টাকা দেওয়া হয়নি। যদি এদের অবস্থা ভালো হয়ে যায় তাহলে কাউকে দিতেও হবে না। প্রয়োজন বোধে দিব।

“যার যত টাকা দরকার সেই অনুযায়ী দেওয়া হবে। তবে এসব ব্যাংকগুলোতে এখন ক্যাশফ্লো ভালো রয়েছে। গত কয়েকদিনে ব্যাংকগুলোর তারল্য উদ্বৃত্ত আছে ৮১০ কোটি টাকা। আশা করি সমস্যা সমাধান হবে।”

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের এমডিকে একসঙ্গে অপসারণ পরবর্তী

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের এমডিকে একসঙ্গে অপসারণ

কমেন্ট