তারল্য সংকট: এফএসআইবিকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে সিটি ব্যাংক
তারল্য সংকটের কারণে ফার্স্ট সিকিউরিটির ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা গত সপ্তাহে গ্রাহকদের চাহিদামত অর্থ দিতে পারছিল না। কোনো কোনো গ্রাহক ২০ হাজার টাকার চেক এনেও টাকা তুলতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়েন।
তারল্য সংকটে ডুবতে বসা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে (এফএসআইবি) ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে সিটি ব্যাংক।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে এই ঋণের গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে এফএসআইবি। সেখানে সিটি ব্যাংকের কাছে থেকে তারল্য সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
আবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “সিটি ব্যাংক যেহেতু তারল্য সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে, সেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে। আবেদন পর্যালোচনা করে উপযুক্ত মনে হলে দ্রুততার সঙ্গে এই ঋণের গ্যারান্টি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আজকেই (সোমবার) এই ঋণ দেওয়ার জন্য অনুমোদন দেয়, তাইলে কাল (মঙ্গলবার) থেকেই তারল্য সহায়তা পাবে এফএসআইবি। এমনিতে সিটি ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো। তাদের যথেষ্ট তারল্য থাকায় তারা সহায়তা করতে রাজি হয়েছে।"
‘ভালো’ অবস্থায় থাকা ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা গত সপ্তাহে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিতে সম্মত হন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে তারল্য দিতে সম্মত হয়েছে সিটি ব্যাংক।
তারল্য সংকটের কারণে ফার্স্ট সিকিউরিটির ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা গত সপ্তাহে গ্রাহকদের চাহিদামত অর্থ দিতে পারছিল না। কোনো কোনো গ্রাহক ২০ হাজার টাকার চেক এনেও টাকা তুলতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়েন।
দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সংকটে ভোগা ডজনখানেক বাণিজ্যিক ব্যাংককে টাকা না ছাপিয়ে কীভাবে সহায়তা করা যায়, তার উপায় হিসেবে এই ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এ প্রক্রিয়ায় আসতে রাজি সবল ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে এ সুযোগ তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারল্য সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের গ্যারান্টার বা জামিনদার হচ্ছে।
সংকটে থাকা সাতটি ব্যাংক ইতোমধ্যে তারল্য সহায়তা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টর হওয়ার আবেদন করেছে। এই সাত ব্যাংক সব মিলিয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ সহায়তা চেয়েছে।
আবেদন করা সাত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা চেয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যারা সাত হাজার ৯০০ কোটি টাকার চাহিদা দিয়েছে।
ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি করে, এক্সিম চার হাজার কোটি, গ্লোবাল ইসলামী তিন হাজার ৫০০ কোটি, স্যোশাল ইসলামী দুই হাজার কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।
এখন পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংকের জামিনদার হওয়ার জন্য চুক্তি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তারা কী পরিমাণ সহায়তা পাবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
যেসব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তারা এখন আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্যারান্টির জন্য পাঠাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দেওয়া গ্যারান্টির আওতায় কোন ব্যাংক কত টাকা নিতে পারবে, তা বিবেচনা করে অনুমতি দেবে।
ফার্স্ট সিকিউরিটির ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া নিয়ে আশাবাদী। সেটি পেলে আজই (সোমবার) আমরা টাকাটা সিটি ব্যাংকের কাছে থেকে পেয়ে যাবো।"
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগই আলোচিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পাচার করেছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা।
ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে ‘অবৈধভাবে’ টাকা বের করে নেওয়ায় তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এসব ব্যাংক মাসের পর মাস বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি রয়েছে কিছু ব্যাংকের।
এসব ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার মুখে উপনীত হলেও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাদের লেনদেন চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। আহসান মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে দেন।
এ অবস্থায় সংকট কাটাতে সাময়িক সুবিধা হিসেবে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সহায়তা ছাড় করানোর আগে তাদের কাছ থেকে ‘ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোট’ রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধার দেওয়া মানে সরাসরি টাকা ছাপানোর মত ঘটনা। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সে কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা বা ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংকগুলো গ্যারান্টার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
কমেন্ট