ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ পৌনে ৫ লাখ কোটি টাকা
মোট খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা ঋণ এবং অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ (রাইট অফ) মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই ঋণের হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২৩ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি, ৫৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
মোট খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা ঋণ এবং অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ (রাইট অফ) মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই ঋণের হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে (ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্তের অংশ হিসেবে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের এই তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিতে থাকা সম্পদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশই দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ। এ পরিসংখ্যান এক বছর আগের চেয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা এবং রাইট-অব ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
এই তিন অঙ্ক যোগ করেই ঝুঁকিপূর্ণ মোট ঋণ হচ্ছে পৌণে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি।
তবে, এরই মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
বিশাল অঙ্কের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু ছিল দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আমার ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে।”
‘ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক প্রভাব এজন্য দায়ী’ মন্তব্য করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক শিক্ষক বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, “ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমর্থনে এই খাতে সুশাসনের অভাব ছিল, অন্যদিকে বড় ঋণগ্রহীতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা নিয়েছে।”
৩০ বছর ধরে খেলাপি ঋণ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, “আমি দেখেছি সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলাপিদের লাই দেওয়া, সুবিধা দেওয়া। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এ প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়া হয়; ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের এ সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”
“ঋণখেলাপিরা কোনো বিপদের কারণে খেলাপি হননি। মামলাগুলোকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখছেন তারা। তারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং কোনো ধরনের নিয়ম মানছেন না। এমনকি খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই ইত্যাদি দেশে পাচার করে দিয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়মিত ও পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠিত ঋণ, তদারকির অভাব এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে ধীরগতির কারণে ব্যাংকিং খাতের সম্পদের গুণগত মানের আংশিক অবনতি হতে পারে।
এতে আরও বলা হয়েছে, আড়াউ বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মতো ইস্যুগুলো ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমাতে পারে। ফলে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের সম্পদের মানের অবনতি হতে পারে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ২০২২ সালে প্রায় ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালে একটি অস্থায়ী ও কিছুটা নমনীয় নীতি চালু করে, যেন ব্যাংকগুলো ডাউন পেমেন্ট কমায় এবং ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া প্যারামিটারের ওপর ভিত্তি করে ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখিত নীতিটি ২০২৩ সালে ঋণ পুনঃতফসিল বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।
এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট খাতের (যেমন জাহাজ নির্মাণ ও হিমাগার সংক্রান্ত ঋণ) দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
“এই বিশাল অঙ্কের ঋণ আদৌ আদায় হবে কী না-তা নিয়ে যথেস্ট সংশ্রয় আছে। আর যদি সেটা হয়, তাহলে এটা বলা যায় যে, আমাদের ব্যাংকিং খাত একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। আশার কথা হচ্ছে, অন্তবর্তী সরকার, নতুন গভর্নর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরাতে অনেক কথা বলছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এখন দেখা যাক কি হয়,” বলেন মইনুল ইসলাম।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
কমেন্ট