বিনিয়োগে অশনিসংকেত
বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছি আমরা। বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যতো যাচ্ছে—পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতার পর পরিবর্তনের পর বড় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন কারাগারে অবস্থান করছেন। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন; বিদেশে পালিয়ে গেছেন কেউ কেউ।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে; যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি তলানিতে নেমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমছে। দেশে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে; ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩ বছরের সর্বনিম্ন
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায় পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বেসরকারি ঋণ খাতে বিতরণের পরিমাণ আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে।
সবশেষ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে এর চেয়ে কম, ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এরপর আর কখনো তা ৯ দশমিক ২০ শতাংশের নিচে নামেনি।
অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস অগাস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ; প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে সেপ্টেম্বরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে বেসরকারি ঋণে লাগাম দিয়েছে, সেই মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ফের দুই অংকের ঘরে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার মূল্যস্ফীতির হালানাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তারও আগে জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হল, ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। ছাত্রদের আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে ক্ষমতার পালা বদলের পর সেই অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। দেশে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হয়।
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ৮ আগস্ট থেকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে; স্বস্তি ফিরছে না মানুষের মধ্যে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
করোনা মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
এডিপি বাস্তবায়নে বেহাল দশা
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রথম প্রান্তিকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সম্প্রতি এডিপি বাস্তবায়নের এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
জুলাই ঘিরে আন্দোলন, নৈরাজ্য আর অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্মে নেমেছে।
আইএমইডি’র ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল।
বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩০ কোটি ডলারের নিট এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) এসেছে দেশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এ হিসাবে এই তিন মাসে এফডিআই কমেছে ১৫ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ৪১%
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায় এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১১ লাখ (১৫.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। নিস্পত্তি কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ২৬ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এই তিন মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিকভাবে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহন করছে। ফলে সকল ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরও একটা প্রভাব পড়েছে বলে জানান তিনি।
পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছি আমরা। বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যতো যাচ্ছে—পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপাচ্যের যুদ্ধ—একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
“ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিসহ সব কিছুর আমদানিই কমে গেছে। এমনটা চলতে থাকলে আমাদের কপালে কি আছে কে জানে।”
কমেন্ট