অস্থিরতায় বাংলাদেশের ঋণমান কমাল মুডি’স

অস্থিরতায় বাংলাদেশের ঋণমান কমাল মুডি’স

মুডি’স বলছে, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশের ভেতরে চাহিদা-সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ায় এই ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে রপ্তানি খাতে এবং এতে তৈরি পোশাক খাতে সম্ভাবনা কমে গেছে।

অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থেকে বাংলাদেশের ঋণমান আবার কমিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি’স।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি তাদের সূচকে বাংলাদেশের ঋণমান ‘বি১’ থেকে ‘বি২’তে নামিয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক (ঋণাত্মক)’ অবস্থায় চলে গেছে।

সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রেটিং কমানোর ক্ষেত্রে মুডি’স সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে কারণ হিসাবে দেখিয়েছে।

বিশ্বের প্রধান তিনটি ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের একটি মুডি’স। তাদের ঋণমানের প্রভাব বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।

আর্থিক খাতের বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মুডি’স এর মতো প্রতিষ্ঠান ঋণমান কমালে তা ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়তে দিতে পারে।

এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হতে পারে, কারণ খরচ বেশি হলে বিদেশিরা এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না।

মুডি’স গত ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছিল। সেবার তারা ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়েছিল।

তখন কারণ দেখানো হয়েছিল, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকিতে রয়েছে।

তার দুই মাস পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ।

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত না হলে সার্বিক স্থিতিশীলতা ফিরবে না বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

ব্যবসায়ীরাও চাইছেন একটি নির্বাচিত সরকার ফিরুক। তবে নির্বাচনটি কবে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তার কোনও সুস্পষ্ট ঘোষণা না দেওয়ায় অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

এই অবস্থায় ঋণমান কমানোর ক্ষেত্রে মুডি’স বলছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পর সরকার পরিবর্তনের ফলে উচ্চ রাজনৈতিক ঝুঁকি, নিম্ন প্রবৃদ্ধি সরকারের তারল্যের ঝুঁকি, বৈশ্বিক ভঙ্গুরতা এবং ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এটা স্বল্পমেয়াদী অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে এবং তার ফলে তারল্য ঝুঁকি বাড়ছে।

উচ্চ সামাজিক ঝুঁকির পাশাপাশি সুস্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সাম্প্রদায়িকতার উত্থানও রাজনৈতিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ।

অন্তর্বর্তী সরকার বিশদ সংস্কারের ওপর জোর দিলেও তা কার্যকর করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী মুডি’স।

“অন্তর্বর্তী সরকার যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ বেকারত্ব মোকাবেলাসহ দ্রুত কিছু কাজ না করতে পারে, তবে সংস্কার কাজে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়তে পারে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়লেও গত কয়েক বছরে রিজার্ভের স্থিতিশীলতা কমায় বাহ্যিক কিছু আশঙ্কার ঝুঁকি রয়ে গেছে।

মুডি’স বলছে, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশের ভেতরে চাহিদা-সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ায় এই ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে রপ্তানি খাতে এবং এতে তৈরি পোশাক খাতে সম্ভাবনা কমে গেছে।

মুডি’স ঋণমান কমানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রা (এলসি) ও বিদেশি মুদ্রার (এফসি) ঊর্ধ্বসীমাও কমিয়ে দিয়েছে। এলসির জন্য ঊর্ধ্বসীমা ‘বিএ২’ থেকে ‘বিএ৩’ এবং এফসির ঊর্ধ্বসীমা ‘বি১’ থেকে ‘বি২’ তে নামানো হয়েছে।

বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বিশ্বের প্রধান তিনটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির প্রতিবেদন দেখে কোনও দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।

মুডি’স এর ছাড়া বাকি দুটো আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান হলো ফিচ রেটিংস এবং এসঅ্যান্ডপি (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস)।

ফলে মুডি’স এর এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব রাখতে পারে।

বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক—এই তিন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

গত ২২ অক্টোবর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সাম্প্রতিক বন্যার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে।

এর আগে গত এপ্রিলে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল আইএমএফ।

গত ১০ অক্টোবর প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ৪ শতাংশে নেমে আসবে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রতিবেদনে এডিবি বলেছে, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে।

আওয়ামী লীগ আমলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। পতনের দুই মাস আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ লক্ষ্য ধরেছিল।

‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না’ পূর্ববর্তী

‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না’

এস আলমের শেয়ার বেচে টাকা তুলবে ইসলামী ব্যাংক পরবর্তী

এস আলমের শেয়ার বেচে টাকা তুলবে ইসলামী ব্যাংক

কমেন্ট