৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী বাজেট পেশ
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের দৃষ্টি কারতে আরেকটি উচ্চাভিলাষী বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে হাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার মধ্যেই ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী সরকারি আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন ৫ লাখ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। তবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাজেটে মোট ঘাটতি ধরেছেন ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশের সমান।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার পর জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেট হবে দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট।
আকারের দিক থেকে এটিই হবে দেশের বৃহত্তম বাজেট। চলতি বাজেটের তুলনায় এর আকার হবে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সংসদে পঞ্চম বাজেট উপস্থাপন করবেন। গত বছরের ৯ জুন তিনি ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন।
মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৩ জুন তার প্রথম বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) উপস্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালের ১১ জুন উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় বাজেট। ২০২১ সালের ৩ জুন উপস্থাপন করেন তৃতীয় বাজেট। গত বছরের ৯ জুন উপস্থাপন করেন তার চতুর্থ বাজেট। বৃহস্পতিবার দিতে যাচ্ছেন তার পঞ্চম বাজেট।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম দিয়েছেন ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’। এতে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ করার কথা তুলে ধরবেন তিনি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। তার আগের বাজেটের (২০২১-২২) শিরোনাম ছিল জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম ছিল 'অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা'।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের ১৩ জুন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সেই বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পদযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের সময় এখন বাংলাদেশের’।
এই পাঁচ বাজেটের প্রথমটি বেশ অসুস্থ অবস্থায় দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। বাজেট বক্তৃতা শুরুর পর বারবার থেমে যাচ্ছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে ওই বাজেটের বাকি অংশ উপস্থাপন শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের তিনটি বাজেট করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটের মধ্যে দিতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এবারও সেই সংকটের মধ্যেই আরেকটি বাজেট দিতে হচ্ছে তাকে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোট আর আইএমএফের শর্তের চাপ।
বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। একদিকে স্বস্তি দিতে গিয়ে অন্য দিকে টান পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আইএমএফের শর্ত; যেন কোনো অবস্থাতেই ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো আটকে না যায়। অন্যদিকে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ ফের চড়ছে। এপ্রিলে এই সূচক ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। মে মাসের তথ্য পাওয়া গেলে সেটা দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) গিয়ে পৌঁছতে পারে। এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে ইতিমধ্যেই জোর রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
অর্থনীতিতে টানাপোড়েন, আইএমএফের নানা শর্ত আর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য পৌণে আট লাখ কোটি টাকার বড় বাজেট দিতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন বাজেট। সে হিসাবে আগামী বাজেটের ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) বাস্তবায়ন করবে বর্তমান সরকার। আর নতুন সরকার বাস্তবায়ন করবে বাকি ছয় মাস জানুয়ারি থেকে জুন।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই সোয়া বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে। বাজারে ডলারের সংকট এখনও কাটেনি।
এমন সংকটকালেই টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। মূলত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা সাজিয়েছে সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান কবে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। ফলে আগামী বছরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। সে জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উঠে। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে।
এবারও ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। বিবিএস ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাব কষে বলেছে- এবার ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি বলছে ৫ শতাংশের কিছু বেশি হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে; কবে শেষ হবে- নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। যুদ্ধের প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়ছে অর্থনীতিতে। ডলারের দর বেড়েই চলেছে; ৮৬ টাকার ডলার হাতে গুনে ১০৯ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এক বছরে বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ডলারের এই উল্লম্ফনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়ছে।
এদিকে অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে যোগ হয়েছে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসব সংকটের মধ্যেও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেটি কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী সরকারি আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব করবেন ৫ লাখ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। তবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাজেটে মোট ঘাটতি নির্ধারণ করেছেন ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশের সমান।
এই ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহের দুটি উৎস চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে কোন উৎস থেকে কত টাকা তিনি ঋণ করবেন, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। বাজেটের সারসংক্ষেপ থেকে জানা গেছে, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থমন্ত্রী মোট ১ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন। এটি মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৫৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে তিনি ঋণ নিতে চান ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে নেবেন ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা নেবেন বিদেশি ঋণ।
এদিকে প্রায় পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট থেকে অর্থমন্ত্রী খরচের দুটি খাত নির্ধারণ করেছেন। এর একটি হলো সরকারের আবর্তক ব্যয় বা পরিচালন ব্যয়। এর আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, যা মোট সরকারি ব্যয়ের ৬৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং জিডিপির ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যটি হলো উন্নয়ন ব্যয়, যার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছর উন্নয়ন ব্যয়ের মোট আকারকেও দুভাবে নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ব্যয়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ এডিপির জন্য।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে সরকার ব্যয় করবে মোট ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকির বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিদ্যুতে, যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি, রপ্তানি ভর্তুকিতে যাবে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং প্রণোদনায় ব্যয় হবে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভর্তুকিতে ব্যয় হবে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরও সরকারের ব্যয়ের বড় অংশ যাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির খাতগুলোর ব্যয়ে। আগামী অর্থবছর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেট ব্যয়ের ১৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
কমেন্ট