বাজেট অবাস্তব, দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর ‘অযৌক্তিক’: সিপিডি

বাজেট অবাস্তব, দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর ‘অযৌক্তিক’: সিপিডি

ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করের বিধানটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। যাদের করযোগ্য আয় নেই, তারাও এই করের আওতায় পড়বেন। এ কারণে উদ্যোগটি নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক নয়, আবার যৌক্তিকও নয়।

সামগ্রিকভাবে বাজেটের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া সিপিডি বলেছে, এবারের বাজেট অবাস্তব অনুমানে তৈরি। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপট এবং অভ্যন্তরীণ নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে এই বাজেট বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে বাজেজের প্রধান দুটি লক্ষ্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশাল এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

প্রতিবারের মতো এবারও বাজেট ঘোষণার পরের দিন শুক্রবার সকালে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন সিপিডির বাজেট বিশ্লেষক দলের গবেষকরা। রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে বিস্তারিত বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা হচ্ছে উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপ। এ চাপ মোকাবিলায় বাজেটে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপই নেই। উল্টো অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। এটা অবাস্তব এবং অলীক কল্পনা। বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ। এট সূচক কিভাবে অর্থমন্ত্রী ৬ শতাংশে নামিয়ে আনবেন-সেটা আমাদের কাছে কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।”

চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।

“এ ছাড়া বাজেটে এমন কিছু রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে কিছু পণ্যমূল্য বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি মানুষের, তথা ভোক্তার ওপর পড়বে।”

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছেন সাড়ে ৭ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও একই লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাব কষে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে এবার ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আগামী বছর যে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু হবে তা মনে হয় না। তাহলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কভাবে অর্জিত হবে?”

“সে কারণেই আমরা বলছি এটা অসম্ভব; অবাস্তব লক্ষ্য। বাজেটে যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাস্তবভিত্তিক নয়। তাই এসব লক্ষ্য অর্জন শেষ পর্যন্ত হবে না। অতি আশাবাদের বদলে বাস্তবতা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্য ধরাই উচিত ছিল সরকারের।”

অবশ্য বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে বলে আশা করি।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এই কঠিন সময়ে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল যা নেওয়া হয়নি। রেমিটেন্স নিম্নমুখী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কিন্তু নিম্নমুখী; ২৯ বিলিলয়ন ডলারের নেমে এসেছে। বৈদ্যুতিক এবং জ্বালানি খাতে ব্যাপক একটা ঘাটতি দেখা গেছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।”

প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের বিষয়ে বাজেটের বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “নতুন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। পরে এটাকে নামিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। সরকারি বিনিয়োগের হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে যেটা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে কম হয়েছে এখন পর্যন্ত; সেটা ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এখান থেকে লাফ দিয়ে ২৭ শতাংশ কীভাবে হবে? সেটা আমাদের কাছে মনে হচ্ছে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা।”

ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ নিয়ে ফাহমিদা বলেন, “ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এই বছরের ঋণ প্রবাহ যেটা ধরা হয়েছে সেটা গত বছরের ধরা ঋণ প্রবাহের সঙ্গে মিলছে না। ব্যক্তি খাতের যে বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছে সেটা এমন ঋণ প্রবাহ দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।”

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন মনে হয়েছে ফাহমিদার কাছে। তিনি বলেন, “আমাদের আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতির কথা বলা হলেও বৈশ্বিক বাজারে এখন সব পণ্যের দাম নিম্নমুখী। তাই মূল্যস্ফীতিকে এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না, আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেক দুর্বলতা আছে, করকাঠামোর মধ্যে আছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও মনিটারি পলিসির মধ্যেও দুর্বলতা আছে। মুদ্রানীতির সঙ্গে আমাদের আর্থিক নীতির যদি সমন্বয় না থাকে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন হবে।”

করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করাকে ‘খুবই ভালো এবং সময়োপযোগী’  উল্লেখ করেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক। তবে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করারোপের বিষয়টি ভালো হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কারো যদি আয় সাড়ে তিন লাখের নিচেও হয়, তাহলে সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিন লাগবে। করযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার উপর দুই হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না।”

তিনি বলেন, “যে কর দেওয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নাই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক না। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফল মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল।”

বাজেটের সঙ্গে আইএমএফের শর্তের কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থমন্ত্রী পূর্ববর্তী

বাজেটের সঙ্গে আইএমএফের শর্তের কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থমন্ত্রী

সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ল ১২৬২৪ কোটি টাকা পরবর্তী

সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ল ১২৬২৪ কোটি টাকা

কমেন্ট