সুদ পরিশোধেই চলে যাবে লাখ কোটি টাকা
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে হাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার মধ্যেই ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এরমধ্যে ৬৩ দশমিক ৫৬ শতাংশই খরচ হবে সরকার পরিচালন বাবদ।
৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকার এই পরিচালন ব্যয় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। আর এই টাকার ৪৩ শতাংশ, ২ লাখ ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন এবং সুদ মেটাতে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা চলে যাবে সুদ পরিশোধে, যা মোট রাজস্ব বাজেটের ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরমধ্যে ৮২ কোটি টাকা চলে যাবে অব্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বাকি ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে বিদেশি ঋণের সুদ শোধে।
বিপুল বিদেশি ঋণের বোঝা নিয়ে বছর খানেক আগেই সর্বস্বান্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে এখনও চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনীতির করুণ দশার কথাও উঠে আসছে। এর মাঝেই বাংলাদেশে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এই বাজেট বাস্তবায়নে বিশাল অঙ্কের বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনাও সাজিয়েছেন তিনি।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন তার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। নতুন বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী সুদ পরিশোধ বাবদ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি বরাদ্দ রেখেছেন।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করেছিল সরকার।
এতোদিন রাজস্ব বাজেটের সবচেয়ে বেশি অর্থ চলে যেতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতায়। কিন্তু বিদায়ী অর্থবছর থেকে সুদ পরিশোধের জন্যই বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৮০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা রাজস্ব বাজেটের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা কমে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকায় ঠেকেছে।
তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য ৬২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা খরচ করেছিল সরকার।
নতুন বাজেটে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ৩২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল্ বাজেটে এ খাতের জন্য ৩১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে পেনশন বাবদ ২০ হাজার ৮৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল সরকারের।
শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের পঞ্চম বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। ২৬ জুন এই বাজেট পাস হবে। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
এমন একসময়ে এবার বাজেট দিতে হলো, যখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির ধকল যেতে না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট সাজাতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। সে কথা বাজেট বক্তৃতায় বার বার উল্লেখ করেছেন তিনি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বাড়ে। অন্য অনেক খাতে বরাদ্দ কমানো গেলেও ঋণের সুদ পরিশোধ এবং বেতন-ভাতায় কাঁচি চালানোর সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশের বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা পরিচালন বাজেটকে বলে রাজস্ব বাজেট। আর উন্নয়ন বাজেট পরিচিত সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি হিসেবে।
কমেন্ট