পোশাক শিল্প মালিকরা হতাশ
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। ছবি-এআরএইচ ডটকম
প্রস্তাবিত বাজেটে আশা পূরণ হয়নি দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি শিল্পমালিকদের। খাতটির শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান উম্মা প্রকাশ করে বলছেন, রপ্তানি চাহিদার বিপরীতে পোশাক মালিকেরা যেসব প্রনোদনা চেয়েছিলেন, কর ও শুল্ক কমানো বা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বাজেটে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটেনি।
তিনি বলেন, “এবারের বাজেটে রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ‘সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কমতে থাকা রপ্তানি চাহিদার বিপরীতে আমরা যেসব প্রনোদনা চেয়েছিলাম, কর ও শুল্ক কমানো বা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছিলান, বাজেটে সেগুলোর প্রতিফলন হয়নি।”
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন, যাকে তিনি বলছেন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে অভিযাত্রার বাজেট।
সেই বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিজিএমইএর সভাপতি।
সোয়া এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলন চলাকালে বিদ্যুৎ চলে যায় দুইবার। জেনারেটর থাকায় সংবাদ সম্মেলন বন্ধ না হলেও ওই ঘটনাতেই বাস্তবতা বুঝিয়ে দেন ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে বসেই ইলেকট্র্রিসিটির এই অবস্থা, আর আমাদের কারখানাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা করেন্ট থাকে না।”
বাজেটে নতুন অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীদের নেতা ফারুক হাসান বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের এই সংকটের কারণে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হবে না।
লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, “প্রস্তাবিত এই বাজেটে রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা খুঁজে পাইনি। বিশেষ করে উৎসে কর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করার যে প্রস্তাব আমরা করেছিলাম, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।”
তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় অন্যান্য বছরের মত রপ্তানিখাতগুলোর জন্য প্রনোদনার কোনো ঘোষণা আসেনি। পোশাক মালিকদের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব ছিল। সে বিষয়গুলোর কী হলো তা, ‘অজানাই’ রয়ে গেল।”
রপ্তানি বাড়লেও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমাকে ‘খারাপ সংকেত’ হিসেবে দেখছেন বিজিএমইএর সভাপতি। তিনি বলেন, “২০২১ সালের অগাস্টে দেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। সেটা এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। অথচ গত ২১ মাসে আগের ২১ মাসের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
“সংকট আরও ঘনীভূত করেছে রেমিটেন্স প্রবাহের ঘাটতি। এপ্রিল মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ, মে মাসে কমেছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। অন্যান্য সময় দেখা যায়, ঈদের মাসে রেমিটেন্স বাড়ে, এ বছর সেটা ঘটেনি। এগুলো আমাদের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়।”
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে পোশাক পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে জানিয়ে ফারুক হাসান বলেন, “ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি অফিসিয়ালি আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে দেশটি মন্দার কবলে পড়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থাও সঙ্গিন। যুক্তরাষ্ট্রেও কমেছে পোশাক রপ্তানি। ২০২৩ সালে বিশ্ববাজার ছোট হয়ে যাবে।”
এ পরিস্থিতিতে ‘নন-কটন’ পোশাকে ভালো সম্ভাবনা দেখছেন জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বিশ্বের মোট পোশাক বাজারের ৭৫ শতাংশই নন-কটন । কিন্তু বাংলাদেশের মোট রপ্তানির মাত্র ২৬ শতাংশ নন-কটন।
“নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উৎসাহিত করতে রপ্তানি মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ বিশেষ প্রনোদনা দেওয়ার অনুরোধ করেছিল বিজিএমইএ, যা বজেটে প্রতিফলিত হয়নি।”
পোশাক শিল্পের আবর্জনা বা ঝুট পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, “এখানে বিনিয়োগ আনতে আমাদের প্রস্তাব ছিল রিসাইক্লিং শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া, পণ্য ও সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার। তবে বাজেটে এর প্রতিফলিত হয়নি।”
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে আমদানি রপ্তানি সহজীকরণের জন্য কাস্টমস অফিস স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে বিজিএমইএ সভাপতি সংশয় নিয়ে বলছেন, কাস্টমসের অফিসগুলোতে হয়রানি কমবে এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
“বন্ড লাইসেন্স তিন বছরের জন্য রিনিউ করা, যাতে এই সময়ের মধ্যে কাস্টমস অফিসারের কাছে যেতে না হয়। এটা নিয়ে আমরা কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো হয়নি।”
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পোশাক শ্রমিকদেরও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলেছেন, যা এখন রয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্য বাস্তবধর্মী কী না, বিজিএমইএ সভাপতির কাছে তা জানতে চান সাংবাদিকরা।
উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের চ্যালেঞ্জ এখন ফরেন কারেন্সির। এই বছর আরও বিনিয়োগ পাওয়া ও কর্মসংস্থান তৈরি করা খুবই কঠিন। কারণ এখন পাইপলাইনে যেসব ইন্ডাস্ট্রি আছে, তারা গ্যাস কানেকশন পাচ্ছে না। তারা বিদ্যুতের কানেকশন পেয়েও বিদ্যুৎ ঠিকমত পাচ্ছে না।
“আমাদের কাস্টমস-বন্ডের সহজীকরণও হচ্ছে না। আমরা এখনো কষ্ট পাচ্ছি এইচএস কোড থেকে শুরু করে আরও অনেক ইস্যুতে। … তাতে মনে হচ্ছে এই বছর এটা অ্যাচিভ করা সম্ভব নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির ফলে পোশাক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে কী না– এই প্রশ্নে বিজিএমইএ সভাপতি বলছেন, “ভিসা নীতির কারণে আমাদের রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। বাণিজ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আপনি দেখবেন যখন আমরা এসব নিয়ে কথা বলছি, সেই সময় আমরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
“যুক্তরাষ্ট্রের তুলা নিয়ে ৩০ বছর ধরে চলে আসা জটিলতার নিরসন হয়েছে সম্প্রতি। এখন যে যুক্তরাষ্ট্রে কম রপ্তানি হচ্ছে এর কারণ হল বৈশ্বিকভাবেই রপ্তানি কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে না ইনশাল্লাহ।”
সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া জাতিসংঘের বিশেষ দূত অলিভার ডি শাটার একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, বাংলাদেশে পোশাককর্মীদের তিনভাগের একভাগ বেতন দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে সরে যেতে পারে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি স্টেপ বাই স্টেপ ওয়েজেস বাড়াতে। কন্টিনিউয়াসলি সুযোগ সুবিধা বাড়ছে।”
ফারুক হাসান কিছুটা অনুযোগের সুরেই বলেন, “কোভিডের সময় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার যখন বাতিল হল, তখন এই লোকটা (জাতিসংঘের দূত) কোথায় ছিলেন আমি জানি না। আমি যতদূর জানি, উনি অনেক কথা বলে গেছেন, অনেক প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছেন।
“গ্যালারিতে বসে অনেক কথা বলা যায়। মাঠে যে খেলছে, সে আসলে বোঝে পরিস্থিতিটা কী। উনারা রোহিঙ্গা ইস্যু কীভাবে সলভ করছেন তা আমরা দেখছি! কয়জনকে ফেরত নিয়ে গেছেন তারা?”
কমেন্ট