‘বাজেটের লক্ষ্যই ঠিক নেই’
প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য ঠিক নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতির গবেষক সাদিক আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘সংকটের এই সময়ে বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ছিল চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে অর্থনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, সেটাকে স্থিতিশীল করা। কিন্তু সেটা না করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে দৌঁড়ানো হয়েছে।’
শনিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর প্রতিক্রিয়া জানাতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। ব্যবসায়ী এই সংগঠনের সঙ্গে জোট বেধে বাজেট প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
রাজধানীর মতিঝিলে চেম্বার ভবনে সংগঠনের অফিসে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই সহসভাপতি দীর্ঘদিন বিশ্ব ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
সাদিক আহমেদ বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় দেশের বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার ছিল অর্থনৈতিক যে অস্থিতিশীলতা সেটা কমানো। মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলে দেশের মানুষ স্বস্তি পেত। এটা করতে গিয়ে যদি উন্নয়ন কিছুটা বাধাগ্রস্থ হয় তাতে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সেটা না করে বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ।’
তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়ানো দরকার ছিল। ডলারের দাম বাড়ানো দরকার ছিল। সুদের হারকে বাড়িয়ে দিলে মানুষের চাহিদা কমে যেতো। পৃথিবীর সব দেশ এই পথেই তাদের মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে।’
সাদিক আহমেদ বলেন, “ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল তারা সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পাড়ছে না।’
সাদিক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের দরকার ছিলো সুদের হার বাড়তে দেওয়া, তাহলে হয়তো জিডিপি কিছুটা কমে যেতো। কিন্তু তাতে কী? দু’য়েক বছর পরে সেটা আবার কমিয়ে এনে জিপিডি বাড়ানো যেতো।”
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। যে কোনো মুহূর্তে এই সূচক দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে গিয়ে পৌছবে। এটা কমাতে হলে সুদের হার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে সাদিক আহমেদ বলেন, “সুদের হার বাড়িয়ে মানুষের চাহিদা কমাতে হবে। কিন্তু সরকার যেভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সমানে খরচ করছে। এই টাকা মেটাতে টাকা ছাপাতে হচ্ছে। এভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
বাজেটের লক্ষ্যকে অবাস্তব দাবি করে সাদিক আহমেদ বলেন, “বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। সেটা গত বছরের প্রস্তাবিত বাজেট থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেছে প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশর বেশি রাজস্ব বাড়ে না।
কিন্তু সরকার যখন রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ঠিক করলো তখন কেনো আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেট থেকে ১৬ শতাংশ বাড়াল। সবাই জানে এই লক্ষ্য পূরণ হবে না। তাহলে কেনো সরকার এই অবাস্তব লক্ষ্য নেয়। সরকার কাকে বোকা বানাতে চায়?”
ব্যক্তি পর্যায়ে ২ হাজার টাকা করের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এটা সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত। একদিকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে কর মুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হল। অন্যদিকে আবার যাদের আয় নেই তাদের ২ হাজার টাকা কর দিতে বলা হচ্ছে। এভাবে চলে না। বাংলাদেশের বড় লোক কম কর দিচ্ছে।”
কর কাঠামো ঠিক করার দাবি তুলে সাদিক আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশে কর কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। এই কাঠামোতে সরকার ঠিক মতো কর পাচ্ছে না। যার কর দেয়ার কথা সে ঠিক মতো কর দিচ্ছে না। মাঝখান থেকে কিছু টাকা অন্য মানুষের পকেটে যাচ্ছে।”
সংবাদ সম্মেলনে পিআরআই চেয়ারম্যান জাহেদী সাত্তার বলেন, “দেশে সুদের হার বাড়তে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ট্যারিফ কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে দেশে মূল্যস্ফীতি কমবে।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে এসিআই লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ্ দৌলা বলেন, “আগাম কর দিলে সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। আর বাংলাদেশে লভ্যাংশের উপরে দুই-তিন বার কর দিতে হয়ে; এটা বন্ধ করতে হবে।’
এমসিসিআই সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন. করিম বলেন, “দেশে আস্তে আস্তে প্রত্যক্ষ কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। ভ্যাট থেকে রাজস্ব আহরণ কমাতে হবে। কারণ ভ্যাট ধনী গরিব সবাই একই হারে দেয়।”
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “আমি মনে করি ভ্যাট থেকে রাজস্ব আহরণ আরও বাড়ানো দরকার। এখান থেকে সরকার যদি ঠিক মতো কর সংগ্রহ করতে পারে অনেক টাকা আহরণ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে নিম্নবিত্তকে ছাড় দেয়া যেতে পারে।”
সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সুদের হার বাড়িয়ে দিলে জীবনযাত্রার মান কমে যেতে পারে। তাই আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে আগ্রহী।”
এছাড়া ন্যূনতম ২ হাজার টাকা করের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একবার বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা করতে দেন, দেখি কি হয়।”
বিদেশি ঋণে সুদের উপর কর বাড়াবে ব্যবসায়ীদের খরচ
এতদিন ধরে বিদেশি ঋণে সুদের উপর ব্যবসায়ীরা কর অব্যাহতি পেলেও এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে তা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ আরও বেড়ে যাবে বলে আলোচনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এমসিসিআই পরিচালক আদিব এইচ খান।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পরে ১৯৭৬ সাল থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিদেশি ঋণের সৃদের উপর কর যোগ হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এটা পাস হলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের সময়ে সুদের বিপরীতে কর দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। এতে করে বিদেশি ঋণদাতারা সুদের উপর যে কর ধার্য হবে, তা দেবেন না। সুদ কর ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়িয়ে দেবে।”
এই সুদ হার কত হবে, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “২০-৩০ শতাংশ হতে পারে। সরকার এখনও তা পরিষ্কার করেনি। নন-রেসিডেন্সিয়ালদের সৃদ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে হারে কর দেওয়ার বিধান, তা এখানেও প্রযোজ্য হতে পারে।”
সরকার এমন সময়ে বিদেশি ঋণের সুদের উপর কর আরোপের প্রস্তাব করেছে, যখন বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদায় রয়েছে অর্থনীতি। রিজার্ভ নেমে এসেছে ২৯ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৭ হাজার ১৯৩ কোটি ৬৪ লাখ কোটি ডলার। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ২১১ কোটি ২৯ লাখ ডলার, আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। যার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যা মোট ঋণের ৬৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ৭৮৯ কোটি ২৪ লাখ ডলার, যা মোট বেসরকারি খাতের মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিদেশি ঋণের দায় গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার।
বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহীতা খাত হচ্ছে জ্বালানি খাত। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৫৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এরপরই উৎপাদন খাতে ২০৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, ট্রেডিংয়ে ১৩৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ব্যাংকিংয়ে ১৩০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণের উৎসে শীর্ষ দেশ চীন থেকে এসেছে ২৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
এছাড়া হংকং থেকে ১০৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৮৫ কোটি ২১ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৯ দশমিক ৯১ কোটি ডলার, নেদারল্যান্ডস থেকে ৬৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ৬৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, জার্মানি থেকে ৩৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এসেছে।
আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেড়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছের বাংলাদেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। যার মধ্যে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নিট বিনিয়োগ ছিল ৬৬ কোটি ১১ লাখ ডলার।
এর পরই রয়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়ে চীনের ৪৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার। ১১ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।
কমেন্ট