বাজেট বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জ: এফবিসিসিআই

বাজেট বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জ: এফবিসিসিআই

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা চাপের মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করা বেশ চ্যালেঞ্জ হবে। বিশাল এ বাজেট বাস্তবায়নে অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণসহ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, ডলার সংকট দুর এবং বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্সসহ অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেরই গতি নিম্নমুখী। অথচ মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী।”

শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা বলেন তিনি।

লিখিত বক্তব্যে জসিম উদ্দিন বলেন, “আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। বিশাল আকারের এই রাজস্ব সংগ্রহ করা সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বিশ্বে বিভিন্ন সংকটের কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসহ রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া।”

উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছাতে দেশের অর্থনীতির আকার স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছাতে দেশের অর্থনীতির আকার স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এজন্য দেশের বাজেটের আকারও বাড়ছে।”

বাজেটের আকার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৭৯ হাজার ৬১৪ কোটির তুলনায় সাড়ে নয় গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রস্তাবিত ২০২৩-১৪ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যা চলতি বাজেটের তুলনায় ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। বাজেটে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।”

দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের এই আকার অবাস্তব নয়। দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

“রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। তার মধ্যে কর থেকে রাজস্ব আসবে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অংশ ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য রাজস্ব ৭০ হাজার কোটি টাকা।”

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত রাজস্বের মধ্যে মৃসক থেকে সংগ্রহ করা হবে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ, আয়কর থেকে আসবে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক থেকে আসবে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, আমদানি শুল্ক থেকে আসবে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য কর ১ দশমিক ৪ শতাংশ।”

জসিম উদ্দিন বলেন, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা চলছেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কমে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেই কিছু বলতে পারছেন না।

“এ পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে ৫ লাখ কোটি টাকা আদায় করা খুবই কঠিন। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করা আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হচ্ছে “

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশাল এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

এই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থবছর শেষে তা ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হবে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রাথমিক হিসাব দিয়েছে। তার পরও অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ‘স্মাট বাংলাদেশ’ গড়তে গুরুত্ব রাখবে জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম বলেন, “উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা শিরোনামে বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ বাজেট কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নামেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তোলার দিকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।”

দেশের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী, বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। গত ১৪ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি। জিডিপির আকার অনুযায়ী ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ছিলো বিশ্বের ৬০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ১৪ বছরের ব্যবধানে দেশ আজ বিশ্বে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।”

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “সরকারের রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করতে শিল্প উৎপাদন সচল রাখতে হবে। আর এজন্য সাশ্রয়ী এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের বিকল্প নেই। বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি কৌশলী হতে হবে।”

বাজেটের ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেবে সরকার। এরমধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেয়া হবে ব্যাংক খাত থেকে। যা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করবে বলে উল্লেখ করেন জসিম।

এমন অবস্থায়, ব্যাংক খাতের পরিবর্তে সরকারকে কস্ট অব ফান্ড বিবেচনা করে যথাসম্ভব সুলভ সুদে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন প্রাপ্তির বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানানি তিনি।

বাজেটে টেক্সটাইল এবং রপ্তানি খাত ও এসএমই খাতের জন্য তেমন কিছু দেখা যায়নি উল্লেখ করে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, “টেক্সটাইল খাতের উন্নয়নে ম্যান মেড ফাইবার থেকে ভ্যাটসহ সকল ধরনের কর প্রত্যাহার এবং রপ্তানির উৎস কর ১% থেকে কমিয়ে ০.৫ % শতাংশ করার সুপারিশ করছি।”

ব্যক্তিশ্রেণির করসীমার বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “জীবনযাত্রার ব্যয়, মুল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা  বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এই করমুক্ত সীমা ৪ লাখ টাকা করার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছিলাম।  বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করছি।”

অগ্রিম আয়কর (এআইটি) এবং আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর (এটি) ব্যবসায়িক খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে  জসিম উদ্দিন বলেন, “এআইটি এবং অগ্রিম কর বিলুপ্ত করার  প্রস্তাব করেছিলাম আমরা। কিন্তু এ বিষয়ে বাজেটে কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি। অগ্রীম আয়কর যথাযথ সমন্বয়/রিফান্ড না হওয়ায় পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পায়।”

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষায় আরও গুরুত্ব দেওয়ার কোন বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে এফবিসিসিআই জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহসভাপতি আমিন হেলালী, হাবিব উল্লাহ ডন, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যরিস্টার সামির সাত্তারসহ এফবিসিসিআইপরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।

 

বাজেট সংস্কারমুখী ও আশাবাদী: আতিউর রহমান পূর্ববর্তী

বাজেট সংস্কারমুখী ও আশাবাদী: আতিউর রহমান

‘বাজেটের লক্ষ্যই ঠিক নেই’ পরবর্তী

‘বাজেটের লক্ষ্যই ঠিক নেই’

কমেন্ট