দুই হাজার টাকা ‘ন্যূনতম কর’কে স্বাগত জানিয়েছে আইসিএবি
শনিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার সিএ ভবনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন আইসিএবি নেতারা। ছবি: বাসস
রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর আরোপের যে প্রস্তাব করেছেন তাকে সিপিডিসহ অনেক অর্থনীতিবিদ সমালোচনা করলেও দেশের হিসাববিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-আইসিএবি এই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার সিএ ভবনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকারের ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন বাজেট বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি উৎসাহজনক পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে ন্যূনতম আয়কর দুই হাজার টাকা নির্ধারণকে ‘ইতিবাচক’ বলে আইসিএবি মনে করছে।
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন আইসিএবির টেক্সেশন ও করপোরেট ল’জ কমিটির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর এফসিএ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইসিএবির সিইও শুভাশীষ বসু। মাল্টি মিডিয়া প্রেজেনটেশনের মাধ্যমে স্নেহাশীষ বড়ুয়া ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমস সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরেন।
হুমায়ুন কবীর বলেন, “ন্যূনতম কর নতুন নয়। আয়কর অধ্যাদেশের ৮২ (সি) ধারায় ব্যবসায়ে লাভ না হলেও বা অতিরিক্ত উৎসে কর আদায় করা হলেও ন্যূনতম আওতায় কর আদায়, অনাদায়ে সুদ আরোপসহ জরিমানার আইন কার্যকর আছে। বর্তমানে বহু ব্যাংক ডিপোজিট হোল্ডার আছেন বাস্তবে কর দেন (যা উৎসে কেটে রাখা হয়) কিন্তু রিটার্ন জমা দেন না।’
“রিটার্ন জমার আবশ্যকতার কারণে অনেকের রিফান্ড ক্রিয়েট হচ্ছে, তাদের ফাইল মেইনটেইন করতে সার্টিফিকেট ইস্যুর প্রয়োজন হতে পারে, তবে কস্ট রিকভারির জন্য এই ট্যাক্স ইম্পোজিশন অনৈতিক হবে না। এতে করে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো ট্যাক্স নেট তথা রিটার্ন দাতার সংখ্যা বাড়বে।”
আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মনিরুজ্জামান বলেন, ডিভিএস বাস্তবায়ন হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়বে।
ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম বা ডিবিএস ব্যবহার করে আয়করের পাশাপাশি মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) তথ্যও যাচাই করতে পারবেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। এর ফলে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট বা নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে, তা বন্ধ হবে।
আইসিএবি এরই মধ্যে ডিভিএস নামে এই সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে এনবিআর জমা দেয়া অডিট রিপোর্ট সঠিক কি না, তা যাচাই করতে পারবেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। এতে ভুয়া রিপোর্ট জমার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। অডিট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা হবে; বাড়বে রাজস্ব আদায়।
এ বিষয়ে সম্প্রতি এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ ও আইসিএবির মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে এই ডিভিএস বাস্তবায়ন হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নেয়ায় সরকারের প্রশংসা করা হয়। যেমন-পরিবেশ সারচার্জ প্রবর্তন, যা পরিবেশকে রক্ষা করবে, যানবাহনের সংখ্যা কমাবে এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবহার বাড়বে।
একাধিক যানবাহনে বিভিন্ন সিসি বা কিলোওয়াটভিত্তিক পরিবেশগত সারচার্জ আরোপ, ব্যবসা সহজীকরণের লক্ষ্যে ‘মার্কেট প্লেস’কে ‘পণ্যের অনলাইন বিক্রয়’ এর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন উৎসাহিতকরণ এবং স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে করের বোঝা কমাতে ‘অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল’উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশের বেশি ভ্যাট ছাড়ের প্রস্তাব।
রিবেট বা রেয়াত গণনার অস্পষ্টতা দূর করার জন্য আংশিক রিবেটের সূত্রে পরিবর্তন; বন্ডেড পণ্যের ছাড়পত্রের জন্য সাবেক বন্ড বিল অফ এন্ট্রি জমা দেয়া এবং সেই সঙ্গে এটিকে চূড়ান্ত মীমাংসাকরণের জন্য বিল অফ এন্ট্রির সংজ্ঞা প্রতিস্থাপন করা এবং স্থানীয় শিল্প রক্ষার জন্য কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করে আইসিএবি।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তাতে কারও আয় করমুক্ত সীমার নিচে হলেও সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিআইএনের বিপরীতে দুই হাজার টাকা কর নেওয়ার বিধানটি আরোপ করেন তিনি।
পরের দিন শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি এই কর আরোপকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
ওই সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করাকে ‘ভালো বিষয়’ বলে আমরা মনে করি। তবে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করারোপের বিষয়টি ভালো হয়নি।”
তিনি বলেন, “কারো যদি আয় সাড়ে তিন লাখের নিচেও হয়, তাহলে সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিন লাগবে। করযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার উপর দুই হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না।”
ফাহমিদা বলেন, “যে কর দেওয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নাই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক না। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফলে মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল।”
শুধু সিপিডি নয় অন্য সব গবেষণা সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদরাও প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় দুই হাজার টাকা কর আরোপের সমালোচনা করেছেন।
কমেন্ট