সামাজিক সুরক্ষার এক–চতুর্থাংশই যাবে সঞ্চয়পত্রের সুদ ও পেনশনে
ফাইল ছবি
বাজেটের অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা। এই খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। এই অর্থ অসহায় গরিব মানুষের পেছনে ব্যয় করা হয়।
সরকারি দাবি করছে, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ারি। দেশে দারিদ্র ও অতিদারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে-সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থ শুধু অসহায় গরিব মানুষের জন্য ব্যয় করা হয় না। সঞ্চয়পত্রের সুদ ও পেনশনেও ব্যয় হয় এই খাতের মোটা অঙ্কের অর্থ।
গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাতেও এর ব্যতয় হয়নি। বাজেটের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ছিল ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ ও ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মত আগামী অর্থবছরেও এ ক্ষেত্রে ১১৫টি কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাঁদের পরিবারের পেনশন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা, যা মোট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দের ২১ দশমিক ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ মোট বরাদ্দের ৫ ভাগের ১ ভাগ এ খাতে ব্যয় করা হবে।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা।
এ দুই খাতেই ব্যয় হবে মোট ৩৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। এই হিসাব বলছে, সামাজিক সুরক্ষার এক–চতুর্থাংশই বা চার ভাগেরএক ভাগই চলে যাবে সঞ্চয়পত্রের সুদ ও পেনশনে।
ব্যাংক ঋণের সুদহারের তুলনায় জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ দিতে হয়। সুদহারের একটি অংশ সরকার প্রিমিয়াম হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ থেকে দেয়।
সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দ থেকে কৃষি ভর্তুকির জন্য রাখা হয়েছে ২১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সরকার পরিচালিত বিভিন্ন তহবিল এবং সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ ছোটখাটো অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে এই অর্থ। এসএমই খাতের জন্য সুদ ভর্তুকি রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ থেকে পেনশন এবং সঞ্চয়পত্র বাদ দিয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করে আসছেন। বাজেটের আগে ঢাকায় আসা আইএমএফের মিশনও একই সুপারিশ করে।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হচ্ছে, সর্বশেষ বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হয় না। ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের। এ বিবেচনায় এসব কর্মচারীর পেনশন আর্থসামাজিক নিরাপত্তার আওতায় দেখানো হয়। অবশ্য পেনশন ব্যয়ের ৮৩ শতাংশ এসব কর্মচারীর পেছনে যায়।
অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “পেনশন, সঞ্চয়পত্র ছাড়াও কিছু ভর্তুকি এবং সরকারের অন্যান্য কার্যক্রম সামাজিক নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের ৬০ শতাংশই যাবে অন্যান্য কার্যক্রমে। মাত্র ৪০ শতাংশ থাকবে প্রকৃত দরিদ্রদের জন্য।
তিনি বলেন, “সত্যিকারের সামাজিক সুরক্ষা নয় এমন অনেক কর্মসূচি যুক্ত করে বাজেটে অনেক বরাদ্দ দেখানো হলেও গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল।
তাছাড়া উপকারভোগী নির্বাচনে ত্রুটি থাকায় যারা এ ধরনের ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন, তারাও পাচ্ছেন। অনেকে পাওয়ার যোগ্য হলেও পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে সামাজিক সুরক্ষা থেকে প্রকৃত দুরিদ্রদের পাওনা আরও কমে যাবে। বর্তমানে যে হারে ভাতা দেওয়া হয়, সেটাও খুবই কম। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ খুব চাপে রয়েছেন।”
এমন পরিস্থিতে তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে আসল সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা থেকে অন্য অনেক খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ খুবই কম। এর পাশাপাশি সুবিধাভোগী বাছাই প্রক্রিয়ায় গলদ, বাস্তবায়ন পর্যায়ে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ কার্যক্রমের প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই সরকার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর নামে কিছু অপ্রাসঙ্গিক খাত যুক্ত করে রেখেছে। তাই বাজেটে বরাদ্দ বড় করে দেখানো হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। ফলে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শহর ও গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে বর্তমানে যাদের ভাতা দেওয়া হয়, তার পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।”
নতুন অর্থবছরে পেনশন ছাড়াও বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতাসহ ৯টি কর্মসূচিতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা নগদ হিসাবে দেবে সরকার। এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রম-সংক্রান্ত ১১ কর্মসূচিতে ১৬ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা, উপবৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় ৪ হাজার ৫৬৪ কোটি, নগদ/উপকরণ হস্তান্তর বিশেষ কার্যক্রমের আওতায় (সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয় বাদে) ২৮ হাজার ৫০০ কোটি, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা বাবদ ৭০৯ কোটি, বিবিধ তহবিল ও কার্যক্রমে ১০ হাজার ৪৭০ কোটি, উন্নয়ন কার্যক্রমে ১০ হাজার ৫২৩ কোটি এবং ঋণ সহায়তা কার্যক্রমে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীদের ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কার্যক্রমে উপকারভোগীদের দৈনিক ভাতার হার দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করা হচ্ছে।
কমেন্ট