বেসরকারি খাতে ২৭.৪৩% বিনিয়োগ আসবে কোন জাদুবলে
সংকটের মধ্যেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার তিনি জিডিপির মোট আকার ধরেছেন ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
এই জিপিডির ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ হবে বলে বাজেটে লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। এরমধ্যে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ আসবে বেসরকারি খাত থেকে। আর ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ আসবে সরকারি বিনিয়োগ থেকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরমধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর সরকারি বিনিয়োগ ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
গত ১৯ মে এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। তবে এটি চূড়ান্ত নয়, প্রাথমিক বা সাময়িক হিসাব। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর) তথ্য হিসাব করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।
চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়সহ অন্যান্য সূচক কিছুটা কমবেশি হয়ে থাকে। বরাবরই এমনটা হয়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ থেকে এক লাফে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ হবে কিভাবে?
অর্থনীতিবিদরা এই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এই সংকটকালে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা একটা অবাস্তব এবং উচ্চাভিলাসী লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণ হবে না।
‘বেসরকারি খাতে জিডিপির ২৭.৫ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে কোন জাদুবলে’ এই প্রশ্ন তুলে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কোনোবারই ২৫ শতাংশের উপরে যায়নি। আগামী অর্থবছরে সেই বিনিয়োগ সাড়ে ২৭ শতাংশ হবে কিভাবে? কোনো জাদুর কাঠি ছাড়া একটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নানামূখী চাপের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি। এই সংকটে দেশে বিনিয়োগ কমে গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশেও বিনিয়োগে মন্দা চলছে।”
“যুদ্ধের ধাক্কায় দেশে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তব্যাংক লেনদেনেই ডলারের দর ৮৬ টাকা থেকে ১০৯ টাকায় উঠেছে। বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৯ বিলিয়নে নেমে এসেছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
“ফলে আমদানি ব্যয় বেশ কমে গেছে। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনী যন্ত্রপাতি), শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানিই কমেছে। ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্পদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি না করে অপেক্ষা করছেন। কেননা, এখন আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে; সে ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সে অনুযায়ী পণ্যের দাম না পাওয়া গেলে লোকসান হতে পারে। সে কারণে তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে।”
“অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। কয়েক মাস আগে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়েই দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। অর্থমন্ত্রী অযথাই অবাস্তব লক্ষ্য ধরেছেন।”
একই কথা বলেছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
১ জুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পরের দিন ২ জুন প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে ফাহমিদা বলেন, “এই কঠিন সময়ে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল যা নেওয়া হয়নি। রেমিটেন্স নিম্নমুখী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কিন্তু নিম্নমুখী; ২৯ বিলিলয়ন ডলারের নেমে এসেছে। বৈদ্যুতিক এবং জ্বালানি খাতে ব্যাপক একটা ঘাটতি দেখা গেছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।”
প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের বিষয়ে বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “নতুন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। পরে এটাকে নামিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব দিয়েছে ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ হবে। বাজেটে সরকারি বিনিয়োগের হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে যেটা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে কম হয়েছে; ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এখান থেকে লাফ দিয়ে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কীভাবে হবে? সেটা আমাদের কাছে মনে হচ্ছে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা।”
ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এই বছরের ঋণ প্রবাহ যেটা ধরা হয়েছে সেটা গত বছরের ধরা ঋণ প্রবাহের সঙ্গে মিলছে না। ব্যক্তি খাতের যে বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছে সেটা এমন ঋণ প্রবাহ দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে সার্বিক আমদানি ব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আর এই দশ মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে আরও বেশি ২৭ শতাংশ। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনী যন্ত্রপাতি) আমদানি কমেছে ৫৭ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ; মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। টানা সাত মাস ধরে কমছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে; বাড়তে বাড়তে গত বছরের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল।
এর পর থেকে কমছেই। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের মাস মার্চে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিনিয়োগে মন্দা চলছে। জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩১ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে ৩২ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশে উঠে।
কমেন্ট