সরকার অর্থনীতির সংকটের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে: সাদিক আহমেদ

সরকার অর্থনীতির সংকটের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে: সাদিক আহমেদ

সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন পিআরআই’র ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। ছবি: এআরএইচ ডটকম

সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারই ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা বুঝতেই ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সাদিক আহমেদ বলেন, “আমি নতুন বাজেটে চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হচ্ছে-সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, রাজস্ব সংগ্রহ, ভর্তুকি বিচক্ষণভাবে অর্থায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় বজায় রাখা।”

তিনি বলেন, “এই সময়ে সবচেয়ে জরুরি ছিল সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। কিন্তু সরকার তা না করে বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা বুঝতেই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের যে প্রাক্কলন সরকার করেছে, তা বাস্তবসম্মত নয়।”

সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এর চারটি বড় চ্যালেঞ্জ’শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন সাদিক আহমেদ।

তিনি বলেন, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে কোনো টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত না করেই শেষ হচ্ছে।

বিআইডিএস মিলনায়তনে প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় সেমিনারে বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, “বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে বাংলাদেশ নতুন অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছে তাতে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।”

সাদিক আহমেদ আগামী অর্থবছরের চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেগুলো চিহ্নিত করেন, সেগুলো হচ্ছে- ১. সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ২. রাজস্ব সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ ৩. বাজেট ভর্তুকি বিচক্ষণভাবে অর্থায়ন এবং ৪. সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় বজায় রাখা।

এই চার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে পরামর্শ তুলে ধরে সাদিক আহমেদ উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় মুদ্রার যোগান কমাতে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর কথা বলেন। এ নীতি গ্রহণ করে অনেক দেশ ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার সফলতার তথ্য তুলে ধরেন।

বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ শুল্ক বসিয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করে রপ্তানি বাড়ানোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পরার্মশ দেন তিনি। বলেন, “এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।”

সাদিক আহমেদ রাজস্ব সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এনবিআরের পরিষেবা বাড়ানো, ভ্যাট আইন ২০১২ বাস্তবায়ন, সম্পত্তি করের প্রয়োগ ও এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতির দায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সুবিধাজনক, কিন্তু সেটা ঠিক বাস্তবসম্মত নয়।”

“যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ আছে ঠিকই, কিন্তু দেশের বাজারে যথাযথভাবে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

“যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাহিদা হ্রাসের ব্যবস্থা নিয়েছে, সেসব দেশ প্রণিধানযোগ্যভাবে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে পেরেছে। অর্থাৎ যেসব দেশ নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, সেসব দেশ ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার কমাতে পেরেছে।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে থাইল্যান্ডের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতি সব সময়ই ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে ছিল।”

বাজেট ঘাটতির অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে উল্লেখ করে সাদিক আহমেদ বলেন, “দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। সম্ভাব্য বিকল্পগুলো হতে পারে কম সুদের বিদেশি ঋণ।”

অপর চ্যালেঞ্জ সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সরবরাহ এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা রাখার পরামর্শ দেন তিনি। ভর্তুকি কমানো এবং পুঁজি নিবিড় বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।

বিনায়ক সেন বলেন, আগামী বাজেটে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা। এজন্য তিনি ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কৃষি ও সারে প্রয়োজনীয় ছাড়া অন্যান্য ভর্তুকি কমানোর কথাও বলেন তিনি।

ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটাতে ছাড় নয়

‘কর ও ঋণখেলাপিদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত হবে না’ মন্তব্য বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “ব্যাংক ঋণের ৫ বা ১০ শতাংশ জমা দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ কোনোভাবেই থাকা উচিত নয়। রাজনীতিতে এই অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন, তা না হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সম্ভব নয়।”

সেই সঙ্গে সরকারের ভর্তুকি কাঠামো যৌক্তিকীকরণের পক্ষে মত দেন বিনায়ক সেন। বলেন, “জিডিপির ২ শতাংশের মতো চলে যাচ্ছে ভর্তুকিতে, যার বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয়। কৃষি, সার ও সামাজিক নিরাপত্তায় ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বেসরকারি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার অর্থ হয় না।”

“বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমে আসছে, কিন্তু তার সঙ্গে দেশের বাজারে দামের সমন্বয় হচ্ছে না। এটা টেকসই নয়, উচিতও নয়,” এই অর্থনীতিবিদ।

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বিনায়ক সেন মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে উপস্থিত গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতামত জানতে চান। এ বিষয়ে তাদের মত, গত এক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এখন মুদ্রার একক ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ করার সময় এসেছে। কারণ, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে। এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের হ্রাস কমানো যাচ্ছে না।

বিনায়ক সেন আরও বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমে আসছে, কিন্তু তার সঙ্গে দেশের বাজারে দামের সমন্বয় হচ্ছে না। এটা টেকসই নয়, উচিতও নয়।

সেমিনারটি মিশ্র পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ অনেকে সশরীর এতে অংশ নেন, অনেকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অংশ নেন।

টাকা ছাপিয়ে সংকট সামাল দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে: আজিজুল ইসলাম পরবর্তী

টাকা ছাপিয়ে সংকট সামাল দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে: আজিজুল ইসলাম

কমেন্ট