মূল্যস্ফীতিকে যে করেই হোক সামলাতে হবে: আতিউর রহমান
'সমৃদ্ধ ও সুষম বাংলাদেশ নির্মাণ: বাজেট ২০২৩-২৪' শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এই সূচক চড়তে চড়তে প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। এটাকে যে করেই হোক সহসীয় করতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান।
‘মূল্যস্ফীতি গরিবের শত্রু’ মন্তব্য করে আতিউর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি গরিবের পকেট কাটে। এটিকে যে করেই হোক সামলাতে হবে।”
শুক্রবার 'সমৃদ্ধ ও সুষম বাংলাদেশ নির্মাণ: বাজেট ২০২৩-২৪' শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ-ইআরডিএফবি।
আতিউর রহমান বলেন, “বর্তমান সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। এটাকে ৬ শতাংশে আটকে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাজেটে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার সময় যখন দেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন মূল্যস্ফীতি এ মাত্রায় নিয়ে আসতে পারলে তা নিশ্চয়ই একটি বড় অর্জন হবে।”
“তবে বিষয়টি খুব সহজ হবে না। এজন্য নীতিমালা নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি শুধু বাজেট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিরও বিরাট ভূমিকা পালন করতে হয়। আশা করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি করবে।”
তিনি বলেন, “দেশের মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রেহাই দিতে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। ফলে কিছুটা স্বস্তি পাবেন নাগরিকরা। এছাড়া নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের থেকে ৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৪ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।”
“ভর্তুকিতে কাটছাঁটের চাপ থাকার পরও জনজীবনে স্বস্তি আনতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বৃদ্ধি জনস্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা উচিত। বিশেষ করে কম দামে কোটি মানুষকে কার্ডের মাধ্যমে যে খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে, এটি মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য একটি বড় উদ্যোগ। এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এর অর্থ হলো ২০২২ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের মার্চে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে রোববার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) এই মুদ্রানীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মুদ্রানীতি প্রণয়ণের সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আলোচনায় আতিউর রহমান বলেন, “আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমন চ্যালেঞ্জিং সময় এর আগে ১৯৭১ সালে একবার এসেছিল। এখন আবার এমন একটি সময়ের মধ্য আমরা আছি। এ চ্যালেঞ্জে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভূ-তাত্ত্বিক বাস্তবতা। এর কারণে সারা পৃথিবী এখন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আছে।”
“এর মধ্যে আমাদের নিজস্ব যে অবস্থান, নিজের যে শক্তি, আমরা যে ধীরে ধীরে একটি শক্ত পাটাতনের ওপর আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছি, এ সত্যি কথাটি জনগণকে বলতে হবে। শুধু ভালো কাজ করাই যথেষ্ট নয়, জনগণ যাতে মনে করে আমরা ভালো কাজ করছি।”
সাবেক গভর্নর বলেন, “এবারের বাজেটটি একটি আপদকালীন বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করা হয়েছে। এটি একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বাজেট। শুধু ভূ-তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ নয়, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, অনেক সংকট তৈরি হয়েছে। সেই সংকটগুলো মোকাবিলা করার জন্য কী বাজেট করা হয়েছে, সেটি আমাদের জানা উচিৎ।”
“বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তার পেছনে তিনটি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই খাত তিনটি হচ্ছে- কৃষি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স। এ তিনটি খাত আমাদের শক্তির উৎস। আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত পাটাতনের ওপর দাঁড় করাতে এ তিনটি খাত কাজ করেছে।
“গত দেড় দশকে আমরা যে অর্জন করেছি, তার পেছনে এ তিনটি খাতের ভূমিকা অনন্য। ২০০৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ সময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে। বার্ষিক রপ্তানি বেড়েছে পাঁচগুণ এবং রেমিট্যান্স বেড়েছে ছয়গুণ।”
আতিউর রহমান বলেন, “অর্থনৈতিক ও মানবিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের যে সাফল্য অর্জন হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে চলমান সংকটও অতিক্রম করা সম্ভব হবে। তবে তা করার জন্য নতুন বাজেটটি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাজেট দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এটাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বছরটি বাজেট বাস্তবায়নের জন্য কঠিন।”
“কারণ এটি নির্বাচনের বছর। এ বছরের শেষ তিন মাস নির্বাচনের ডামাডোলে উন্নয়ন বেশ খানিকটা ব্যহত হবে। সেজন্য উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য এটি খুবই কঠিন বছর। অনেকে মনে করছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটটি উচ্চাভিলাষী। এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছরে আমরা যে শক্তি অর্জন করেছি, তাতে আমরা মনে করি না এ বাজেটটি উচ্চাভিলাষী। বরং আমি বলব, বাজেটটি ভবিষ্যতমুখী। নির্বাচনের বছরেও কেউ সংস্কারমুখী ও ভবিষ্যতমুখী বাজেট করতে পারে, সেটিও প্রশংসার দাবি রাখে।”
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, “রপ্তানি ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রযুক্তির প্রয়োজন। সেই প্রযুক্তি আসবে শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। যা আমাদের নেই।”
“স্মার্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি। এজন্য ডিজিটাল ক্লাসরুম করতে হবে। ডিজিটাল ক্লাসরুম না করলে ডিজিটাল বাংলাদেশ কীভাবে হবে? অনেক সময় দেখা যায় এসব খাতে বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটি ব্যবহার করা হয় না। এগুলোকে ব্যবহার করতে হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান।
কমেন্ট