এডিপি বাস্তবায়নে মন্থরগতি নিয়েই শেষ হচ্ছে অর্থবছর

এডিপি বাস্তবায়নে মন্থরগতি নিয়েই শেষ হচ্ছে অর্থবছর

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে অনেক কিছু আমদানি করতে হয়; সেই খরচ মেটানোর জন্য যে বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন-সেই মুদ্রার ভান্ডার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। আইএমএফের হিসাবে এই রিজার্ভ আরও কম; ২৪ বিলিয়ন ডলার।

তাই নানমূখী চাপ সামাল দিতে ব্যয় সংকোচন করছে সরকার। তার প্রভাব বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নেও পড়েছে। আর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের এই মন্থরগতি নিয়েই শেষ হচ্ছে অর্থবছর।

৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন আশানুরুপ না হওয়ায় গত ১ মার্চ তা সংশোধন করে প্রকল্প সহায়তা থেকে ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এই সংশোধিত এডিপির ১ লাখ ৪৬ হাজার ২২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ১১ মাসে সংশোধিত এডিপির ৬১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

বাস্তবায়নের এই হার ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেশ খানিকটা কম। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে সংশোধিত এডিপির ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল।

তার আগে ২০২০-২১, ২০১৯-২০ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ৬৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

করোনা মহামারির কারণে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের গতি কম ছিল।

অবশ্য সবশেষ মাস মে মাসের বাস্তবায়নের গতি মোটমুটি ভালো। এই মাসে ২৬ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাস্তবায়নের হার ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ।

গত বছরের মে মাসে খরচ হয়েছেল ২২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ছিল ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বাস্তবায়নের হার ১৫ শতাংশ হলেও এবার এডিপি বাস্তবায়নের হার ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি হবে বলে হিসাব বলছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামাল দিতে ডলার সাশ্রয় ও খরচ কমানোর সরকারি পদক্ষেপের প্রভাব পড়েছে চলমান এডিপি বাস্তবায়নে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ সব সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেছেন, “তারপরও গত কয়েক বছরের মতো বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়ন ৮০ শতাংশের বেশি হবে।”

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সোমবার সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়নের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থাৎ বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সংশোধিত এডিপির সরকারি অংশের ৫৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রকল্প সহায়তা বা বিদেশি অর্থায়নের ৭০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ব্যয় করেছে।

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিরি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ২০ শতাংশের মত বেড়েছে। ৯০ টাকার ডলার কিনতে এখন ১০৯ টাকা লাগছে। এতে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। রডের টন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। সিমেন্টসহ অন্যান্য সামগ্রীর দামও বেড়েছে।”

“বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারও ডলার সাশ্রয় ও খরচ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব কারণে অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। তাই সব মিলিয়েই এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। আমার মনে হয়, আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার অর্থবছর শেষেও এডিপি বাস্তবায়ন কম হবে।”

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পকে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে সি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে এবং সেগুলোর জন্য অর্থায়ন সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।

সরকার সাধারণত প্রতিবছর মোট এডিপির ৮০ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির ৯০ শতাংশ ব্যয় করে। এ বছর সার্বিক এডিপি বাস্তবায়ন ৮০ শতাংশে উন্নীত করা নির্ভর করবে সরকারের তহবিল বিতরণ সক্ষমতার ওপর।

বাস্তবায়নের ধীরগতি প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএমইডির এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের উদ্যোগ থাকায় বিদেশি পণ্য আমদানি করতে হয়-এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। আবার অনেক সময় প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ঠিক থাকলেও প্রকল্পের অর্থছাড় সময়মতো না হাওয়ার কারণেও বাস্তবায়ন কম হয়।”

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের অর্থনীতিও চাপের মধ্যে পড়েছে। সে কারণে আমাদের ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিতে হয়েছে। তবে চাপ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমার মনে হয়, অর্থবছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনকই হবে।”

আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই-মে সময়ে বিদেশি ঋণের প্রকল্পের বাস্তবায়ন তুলনামূলক ভালো। প্রায় ৭১ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে এসব প্রকল্পে। টাকার অঙ্কে যা ৫৩ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ৫৭ শতাংশ; ব্যয় হয়েছে ৮৭ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।

আর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব জোগানের প্রকল্প ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা; বাস্তবায়নের হার ৬০ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ খরচ করেছে মোট বরাদ্দের ৬৮ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদুৎ বিভাগ ব্যয় করেছে ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। রেলপথ বিভাগ খরচ করেছে ৭১ দশমিক ৮২ শতাংশ।

স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যয় করেছে ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ অর্থ। সেতু বিভাগ ও কৃষি মন্ত্রণালয় খরচ করেছে যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ১২ ও ৬০ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় খরচ করেছে ৬২ দশমিক ২১ শতাংশ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বরাদ্দের ৬২ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।

 

সিপিডির সংলাপে মান্নান-খসরু বাহাস পরবর্তী

সিপিডির সংলাপে মান্নান-খসরু বাহাস

কমেন্ট