কর রাজস্বের ৪৩ শতাংশই চলে যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে করছাড় প্রত্যাহার করা হলে আগামী ৩ থেকে ৪ বছরে ৬০০ বিলিয়ন বা ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব।
সরকার দেশের মানুষের কাছ থেকে কর বাবদ যে রাজস্ব আদায় করে তার ৪৩ শতাংশের বেশি চলে যায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
পিআরআই বলছে, গত ১২ বছরে কর রাজস্ব মোটামুটি ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশে স্থিতিশীল থাকলেও সরকারি বেতন-ভাতা বেড়েছে ৪০৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একই সময়ে পেনশন ও গ্র্যাচুইটি ৫১৯ শতাংশ বেড়ে ২৯ হাজার ১০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট কর রাজস্বের ৯ শতাংশের সমান।
মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে আমারি হোটেলে 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ-অপরিহার্য ও একটি রোডম্যাপ' শীর্ষক অনুষ্ঠানে এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠানে আহসান মনসুর বলেন, “বেতন-ভাতা বাবদ এই বিশাল ব্যয় নিয়ে আমাদের ভাবা উচিৎ।”
করছাড় তুলে দিলে ৪ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে করছাড় প্রত্যাহার করা হলে আগামী ৩ থেকে ৪ বছরে ৬০০ বিলিয়ন বা ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব। আর্থিক খাতে মধ্যমেয়াদি সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৪১ সাল নাগাদ ৪৯ ট্রিলিয়ন বা ৪৯ লাখ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক খাত টেকসই করতে করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা করে করছাড় বাদ দিতে হবে। এতে ৪ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে।
কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে বিতর্ক
অনুষ্ঠানে আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় তারা নতুন করে টাকা ছাপাবে না। দেশের ব্যাংক খাতে এ বছর সব মিলিয়ে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো আমানতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
“ফলে ব্যাংক খাতের পুরো অর্থ সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন হলে ব্যক্তি উদ্যোগের কী হবে?” প্রশ্ন তোলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুরের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, “আমি মনে করি, বেশি ঋণ নেওয়া ভালো জিনিস। যত বেশি ঋণ নেওয়া হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তত বাড়বে।”
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে কর জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ; দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সবচেয়ে কম। আমাদের কর জিডিপির হার সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি।
“সংস্কার না করা হলে আগামী বছরে এই হার আরও কমবে। আর ১০ শতাংশের কম কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়।”
এ বক্তব্যের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “সবাই উৎসাহের সঙ্গে বলেন, দেশে কর-জিডিপির অনুপাত হতাশাজনক। কিন্তু সবাই বিষয়টি সেভাবে দেখেন না। কর জিডিপি নিয়ে সোমালিয়া কঙ্গোর সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। সে সব দেশের সঙ্গে তুলনা করলে সব কটি মানদণ্ড নিয়ে তুলনা করতে হবে।”
“গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যাদের কর জিডিপি হার বেশি, তাদের রাজস্ব আয়ের উৎস দেখতে হবে। যেমন মালদ্বীপের কর-জিডিপির হার বেশি। সেখানে রাজস্ব আদায়ের মূল উৎস পর্যটন খাত। আমাদের কিন্তু এমন উৎস নেই।”
অনুষ্ঠানে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, গত পাঁচ বছরে ১২০ ধরনের করছাড় দিয়েছে সরকার। এভাবে ব্যবসা ও শিল্পে সুবিধার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে করছাড় দেওয়া হচ্ছে। তবে ২৫ বছর ধরে (দীর্ঘদিন) এমন সুবিধা থাকা উচিত নয়।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম এবং ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলেন ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। রাজস্ব সংগ্রহে বাণিজ্যিক করের ওপর বিশেষ আলোচনা করেন পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার।
কমেন্ট