ক্ষত সারাতে প্রবৃদ্ধির ঘোড়া থামালেন অর্থমন্ত্রী
মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেলেও রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আয়করে কোনও ছাড় দিতে সাহসী হননি মাহমুদ আলী। অর্থের জন্য মুখিয়ে থাকা সরকার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার যে ঢালাও সুযোগ দিয়েছে, তাও পড়েছে সমালোচনায়।
উন্নয়নের নজির হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির অঙ্ককে দশককাল ধরেই সামনে ধরে রাখছিল আওয়ামী লীগ। সংকটের মধ্যে এবার সেখানে লাগাম টেনেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থবছরের বাজেটে উচ্চাভিলাষী না হয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা তিনি ঠিক করেছেন বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির খাঁড়ায় জনজীবনে যখন অসন্তোষ, তখন প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার দিকে নজর দিতে সরকারের কাছে পরামর্শ রেখেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তাতে দৃশ্যত অর্থমন্ত্রীর সাড়া দেখা দিলেও এই প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়ে দুটি বাজেট দেওয়া এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার আশাবাদ অর্থমন্ত্রী করলেও তা নিয়েও সন্দিহান অর্থনীতিবিদরা। কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, তার কোনও দিক-নির্দেশনা বাজেটে না পাওয়ার কথাও বলছেন তারা।
মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেলেও রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আয়করে কোনও ছাড় দিতে সাহসী হননি মাহমুদ আলী। অর্থের জন্য মুখিয়ে থাকা সরকার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার যে ঢালাও সুযোগ দিয়েছে, তাও পড়েছে সমালোচনায়।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী ঠিক করেছেন, তাতে উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে এফবিসিসিসিআই।
মাহমুদ আলী ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র, কিছুদিন শিক্ষকতায় করেছিলেন। কিন্তু ক্যারিয়ার গড়েন কূটনীতিক হিসাবে, চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে নামার পর মন্ত্রিসভায় প্রথম এসে হয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে তিনি এবছর আবার যখন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ফিরলেন, তখন তিনি পেলেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। বৈশ্বিক পর্যায়ে কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আর দেশে অব্যবস্থাপনায় যখন অর্থনীতি সংকটে, তখন নিজের প্রথম জাতীয় বাজেট নিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদে এলেন মাহমুদ আলী।
কৃচ্ছ্র সাধন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন তিনি। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের কথা স্বীকার করে নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ করে বাজেটের আকার খুব একটা বাড়াতে সাহসী হননি তিনি।
টানা চতুর্থ মেয়াদের আওয়ামী লীগের সরকারের হয়ে প্রথম বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে ফর্দ তিনি হাজির করেছেন, তা বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে মাত্র ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশের মতো বড়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি) তিনি বাড়িয়েছেন মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন মির্জ্জা আজিজ।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এই সংকটের সময় অর্থমন্ত্রী যদি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও অর্জন করতে পারেন, সেটাও যথেষ্ট অর্জন হবে বলে আমি মনে করি।
“আমি অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকেই বেশি নজর দিন। কেননা, দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমানোই এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিৎ।”
প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার আশার কথা শোনালেও করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকাই রাখা হয়েছে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ করদাতাদের কোনও ছাড় দেওয়া হয়নি। উল্টো অনেক পণ্যের শুল্ক ও কর বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীও স্বীকার করেছেন মূল্যস্ফীতি তার সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি আমাদের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চাহিদার রাশ টেনে ধরা এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করার দিকে আমরা বিগত দুটি বাজেটে সর্বাত্মক মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলাম।
“এর পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণের পাশাপাশি সহায়ক রাজস্ব নীতি, অর্থাৎ ব্যয় হ্রাস, কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিরুৎসাহিতকরণসহ বিভিন্ন কৃচ্ছ্র সাধন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এতদসত্ত্বেও মূলত আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটিজনিত কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি অনমনীয়ভাবে ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। সেকারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমরা ফিসক্যাল কনসোলিডেশন তথা বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং সীমিত কলেবরে হলেও বাজেট belt tightening তথা কৃচ্ছ্র সাধন অব্যাহত রাখব।”
তবে দীর্ঘমেয়াদে কৃচ্ছ্র সাধনও যে আবার প্রবৃদ্ধির গতি আটকে দিতে পারে, তাও মাথায় রাখতে হচ্ছে মাহমুদ আলীকে।
তার দাওয়াই হিসাবে তিনি বলেন, “সে কারণে আমাদের লক্ষ্য থাকবে আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি ব্যয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা।
“এটি সম্ভবপর হবে। যদি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। সে লক্ষ্যে আমরা কর অব্যাহতি ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির দিকে নজর দেব।”
নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে।
এবার এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে কর রাজস্ব থেকে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে ঘাটতির কারণে ২০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়। ফলে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
ডলার সংকটে মেটাতে আইএমএফ থেকে যে ঋণ নিয়েছে সরকার, তার জন্য নানা শর্তের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। তার এক শর্তে আগামী অর্থবছরে সরকারকে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে।
বিদায়ী অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
তবে এই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও অর্থবছরের শেষ দুই মাসে অর্থাৎ মে-জুন মাসে এক লাখ ২০ হাজার ৬২২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রধান সংস্থা এনবিআরকে।
এমন প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এনবিআরের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় খুবই কঠিন। আর যদি সেটা না হয়, যদি বিনিয়োগ না বাড়ে, তাহলে কিন্তু ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোনওভাবেই সম্ভব নয়।”
ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে।
বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, “এবারের বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আদায় কঠিন। তবে করের আওতা যদি বাড়ানো হয়, তাহলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। কিন্তু শুধু যারা কর দিচ্ছেন, তাদের ওপরই নির্ভরশীল থাকলে কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।”
বাজেটের আকার কমে যাওয়াকে ‘বাস্তবসম্মত’ মনে করছে এফবিসিসিআই। তবে মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোয় হতাশা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রায় উদ্বেগ জানিয়ে মাহবুবুবল বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
“এই প্রস্তাব অনেক বেশি। সরকার ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়া জটিল হবে, কষ্টকর হবে। ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিদেশ থেকেও ঋণ নিতে পারলে ভালো হবে।”
অতীত ইতিহাসে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের সুফল না মিললেও বিনিয়োগ বাড়াতে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী; যা দুর্নীতি সহায়ক হবে বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে টিআইবি।
অনেক লক্ষ্য যে কঠিন, তা অর্থমন্ত্রী নিজেও বুঝছেন; তাই তার বাজেট বক্তৃতায় যদি শব্দটি এসেছে কয়েকবার। তবে তিনি ভরসা রাখছেন বাংলাদেশের মানুষের ওপর।
সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে শত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অপরাজেয় প্রত্যয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এদেশ, সেই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে ধরেই বাজেট পরিকল্পনা সাজানোর কথা বলেছেন তিনি।
কমেন্ট