সংকোচনমূলক নীতিকৌশলেও ৬.৭৫% প্রবৃদ্ধি হবে, কমবে মূল্যস্ফীতি: অর্থমন্ত্রী
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন শুক্রবার বিকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়নে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সংকোচনমূলক নীতিকৌশল সত্বেও তা অর্জিত হবে; আর মূল্যস্ফীতিও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
দীর্ঘদিনের প্রথা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন শুক্রবার বিকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়নে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই লিখিত বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী তার এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
এ সময় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরাও তার সঙ্গে ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, “বৈশ্বিক কারণে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংকোচনমূলক নীতিকৌশল। এর ফলে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মধ্যে ছিল। এটাকে কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক নীতিকৌশল চলমান থাকবে।
“যেহেতু সংকোচনমূলক নীতিকৌশল আরও কিছুদিন চলমান থাকবে, সেহেতু মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। বাজেটে আমরা (মূল্যস্ফীতি) ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য ধরেছি, সেটা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে সংকোচনমূলক নীতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাজেটে আমরা মূল্যস্ফীতি কমানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। আর এজন্য যা কিছু করা দরকার আমরা করবো। আর এ কারণে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে—এটা আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই।
“সংকোচনমূলক নীতিকৌশলের পরও বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। সংকোচনমূলক এই নীতিকৌশল সত্বেও আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবো।”
তবে সংকোচনের নীতির মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারা যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার ওপর জোর দেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমাদের কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাত যেন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর ফলে সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ স্বত্বেও চলতি অর্থবছরে ৫.৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হব।”
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটাই তার প্রথম বাজেট।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশীয় উৎস থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব জোগানের কথা বলা হয়েছে। তাতে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশের সমান।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম উদ্বেগের সূচক মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সময়ে ১১ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে, যা বহু বছরের মধ্যে বেশি। তাতে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
দুই বছরে ধরে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে থাকার প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী নিজের পরিকল্পনায় ঠিক থাকতে পারবেন কি না—এ বিষয়ে শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে সংশয় প্রকাশ করেছে অর্থনীতির গবেষক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
তবে লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলছেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করছি।
“আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে রাখা সম্ভব হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির আওতায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করেছি।”
কোভিড-১৯ মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখনও আমাদের দেশে ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাদের দেশে সুদের হার বাড়াতে থাকলে আমাদের দেশে ক্যাপিটাল ফ্লো কমে যেতে থাকে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
“এর ফলে আমাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য ডেপ্রিসিয়েশন ঘটে। আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা ক্ষমতায় আসার পর মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকলেও আমরা কিন্তু তা দুই বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম।
“এবারও আমরা যেসকল পদক্ষেপ নিয়েছি, তার ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, এটা আমি আপনাদেরকে দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই।”
মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ওএমএস এবং ফ্যামিলি কার্ডসহ যে সকল কার্যক্রম চলছে, তা চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে এগুলোর পরিসর আরও বাড়াবার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে,” বলেন অর্থমন্ত্রী।
গভর্নরকে বর্জন সাংবাদিকদের
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন গভর্নর। সে জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কেউ তার বক্তব্য শুনব না। তিনি যেন কোনও বক্তব্য না দেন, সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বক্তব্য দিলে আমরা তা বয়কট করব।”
এরপর পুরো সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেননি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ সময় গভর্নরকে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে অর্থমন্ত্রীর ডান পাশে বসেছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
মঞ্চে অর্থমন্ত্রীর বাঁ পাশে বসেছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
কমেন্ট