মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বাস্তবভিত্তিক নয়: সানেম
প্রতিবারের মতো এবারও প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনার জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সানেম। শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ানোর যে লক্ষ্য ধরেছেন, তা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা বলেছেন, অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই এখন নেতিবাচক। টানা ১৫ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে বাংলাদেশ। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ফিরছে না। সময়মতো সংস্কার না হওয়ায় অর্থনীতির ভিত্তিগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এ জন্য বৈশ্বিক ধাক্কার ধকল সইতে পারছে না।
“সে কারণেই বাজেটে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমানো, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং রিজার্ভ বাড়ানোর যে লক্ষ্য ধরেছেন তা বাস্তবভিত্তিক নয়; এ সব লক্ষ্য পূরণও সম্ভব নয়।”
প্রতিবারের মতো এবারও প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনার জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সানেম। শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
শুরুতে বাজেটের ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সায়মা হক বিদিশা। তাতে তিনি নতুন বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সূচকের লক্ষ্য নিয়ে এই মন্তব্য করেন।
পরে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রস্তাবিত বাজেটের নানা দিক তুলে ধরেন।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা রেখে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার আশা ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী। আর ‘গ্রস’ রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। গড় মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বাজেপের পেশের আগের দিন ৫ জুন ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
সংবাদ সম্মেলনে সায়েমা হক বলেন, “সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। মোটাদাগে বলতে গেলে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ক্ষয় এখন বড় বিষয়। সে জন্য বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে, কিছু পণ্যের উৎস কর কমানো হয়েছে ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়েছে। এটা ভালো দিক। এর সুফল কিছু জনগণ পাবে।
“তবে সাড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এটি অর্জন করতে হলে বাজেট ছোট করার পাশাপাশি আরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাজেটে সে ধরনের কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “করহার বাড়ানোর দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, করের আওতা বাড়ানোর দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। মধ্যবিত্তকে স্বস্তি দেওয়ার বদলে অস্বস্তি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো এমনিতে তারল্যসংকটে আছে, ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংকঋণ নেওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিলে (ছাপিয়ে) মূল্যস্ফীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
ডলারের সংকট ও রিজার্ভ নিয়ে সায়েমা হক বলেন, “আগের মতো প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এক ডলারের নানা রকম দর যত দিন থাকবে, তত দিন হুন্ডি থাকবেই। পাশাপাশি কালো টাকা উপার্জন বন্ধ না করলে হুন্ডি চলতে থাকবে। প্রণোদনা দিয়ে সাময়িকভাবে প্রবাসী আয় বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যার সমাধান হবে না।”
আর্থিক খাত নিয়ে সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে ভুগছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে; কিন্তু ব্যাংক খাত সংস্কারে কোনো পদক্ষেপ বাজেটে দেখা যায়নি।”
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “এত উদ্যোগের পরও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ৬-৯ সুদহার ছিল ভুল নীতি। যাদের টাকার প্রয়োজন ছিল, তারা কম সুদে ঋণ নিয়ে খরচ করেছেন। এখন সুদহার বাড়ানো হয়েছে। চাপে পড়া মানুষ ইতিমধ্যে সেই সংকটে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন। ফলে সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অনেক মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। যথাসময়ে যথাযথ নীতি না নেওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে।”
সেলিম রায়হান বলেন, “করোনার আগে অর্থনীতি ভালো অবস্থায় ছিল। সে সময় ছিল অর্থনৈতিক সংস্কারের সুবর্ণ সময়। কিন্তু সবার তাগাদা সত্ত্বেও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল আমাদের অর্থনীতি নিতে পারেনি। সংস্কার না হওয়ায় আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত অবস্থায় নেই। বাংলাদেশের মতো ভিয়েতনামও একই রকম ধাক্কা খেয়েছিল; কিন্তু তাদের অর্থনীতি ধাক্কা সামলে নিতে পেরেছে।”
এখনই ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কারের পথনকশা প্রণয়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান।
“ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে প্রভাবশালী ও ধনীরা কর দিচ্ছেন না বা নানা রকম ছাড় পাচ্ছেন। সংস্কার না হলে সহজেই সঠিক পথে উঠতে পারবে না দেশের অর্থনীতি। মনে হচ্ছে, সংস্কারবিরোধী গোষ্ঠী অনেক বেশি শক্তিশালী; কর ও ঋণখেলাপিরা একসূত্রে গাঁথা।”
তিনি বলেন, “অতিধনীদের করের আওতায় আনা না গেলে ও ন্যায্যভাবে কর আদায় করতে না পারলে কর ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা আসবে না। কালো টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ সাংবিধানিক চেতনাবিরোধী। এটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে; দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। দরিদ্র ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের জীবনে তার প্রভাব পড়ছে।”
“এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর সময় নয়। নিকট ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা প্রধান কাজ। পাশাপাশি দরিদ্রদের স্বস্তি দিতে আরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।”
সংবাদ সম্মেলনে সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইশরাত হোসাইন, আফিয়া মোবাশ্বিরা তিয়াশা, নাফিসা জামানসহ অন্য গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন।
কমেন্ট