বিদেশি ঋণ বেশি নিন: সরকারকে এফবিসিসিআই

বিদেশি ঋণ বেশি নিন: সরকারকে এফবিসিসিআই

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শনিবার ঢাকার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এই অনুরোধ জানান এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।

প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার যে পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী করেছেন, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। তারা বাজেট ঘাটতি মেটাতে কম সুদের বিদেশি ঋণ বেশি নেওয়ার অনুরোধ করেছে সংগঠনটি।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, “সরকারকে সুদের বোঝা টানতে হচ্ছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অধিক মাত্রায় সরকারের ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বাজেট-ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংকব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব কম সুদে ও সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের জন্য নজর দেওয়া যেতে পারে।”

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শনিবার ঢাকার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অনুরোধ জানান মাহবুবুল আলম।

সেইসঙ্গে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে পুঁজিবাজারে আসার পরামর্শ দিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা রেখে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী।

তাতে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এই বিষয়ে উদ্বে প্রকাশ করেই মাহবুবুল আলম অর্থমন্ত্রী কম সুদের বিদেশি ঋণ বেশি নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এই ঋণের ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের সম্ভাব্য ক্ষতি তুলে ধরে এফবিসিসিআই সভাপতি লিখিত বক্তব্যে বলেন, “বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব সুলভ সুদে ও সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের জন্য নজর দেয়া যেতে পারে।”

এক সাংবাদিকদের প্রশ্নে মাহবুবুল আলম বলেন, “ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সব দেশের সরকারই ঋণ নিয়ে থাকে। এ জন্য যে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না, বিষয়টি সে রকম নয়। তবে সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে কষ্ট হবে।”

ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য পুঁজিবাজারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “ভালো ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে না। তবে আর্থিকভাবে লাভজনক নীতি নেওয়া হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে।

“যারা পুঁজিবাজারে আসবে তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ও থাকতে হবে। বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান এ দেশে ব্যবসা করছে তাদের যদি পুঁজিবাজারে আনা যায়, তাহলে আরো অনেক মানুষ পুঁজিবাজার নিয়ে আগ্রহী হবে। পুঁজিবাজার থেকে ব্যবসায়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নও সম্ভব হবে। তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ যেমন মিলবে একইভাবে দেশে শিল্পায়নও বাড়বে।”

‘আমরা অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে নই’

খেলাপি ঋণ নিয়ে অঅরেক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, “আমরা সৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে, অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে এফবিসিসিআই কোনো ওকালতি কোনোদিন করেনি, করবেও না।

“এখন কথা হচ্ছে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয় সেটা এক জিনিস আর ব্যবসা করতে গিয়ে কেউ যদি ঋণখেলাপি হয়, সেটা আরেক জিনিস।”

একটা ব্যবসা বা গ্রুপ দাঁড় করানো সহজ নয় মন্তব্য করে মাহবুবুল বলেন, “একটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ হতে কমপক্ষে ৫০-৬০ বছর লাগে। ব্যবসা করতে-করতে এক সময় ব্যবসাতে লস হতে পারে। একটা কোম্পানি বা দুইটা কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তখন আমরা দেখি তার আরেকটা কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিল। সে জন্য আমরা অনুরোধ করেছি যে আমার ১০টা কোম্পানি আছে, ব্যবসা করতে গিয়ে একটা কোম্পানি খেলাপি হয়ে গেল, ৯টা কোম্পানিকে যেন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা দিয়ে সাহায্য করে বা ব্যবসাটা করতে দেয়।”

ঋণ দেওয়ার পর সেসব ঋণের দেখভাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যাকে ঋণ দিচ্ছেন তাকে ফলোআপ করতে হবে, যাতে সে ঋণখেলাপি না হয়। তার অর্থ স্থানান্তর করছে কিনা, সেটাও আপনাকে দেখতে হবে। এগুলো একটি মনিটরিং পলিসিতে আনতে হবে।

এক বছর খারাপ হলে সেই ব্যবসা একেবারেই খারাপ হয়ে যায় না মন্তব্য করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “সে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিলে (ঋণ না দিলে) ওই কোম্পানি একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।”

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক নয়

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাবের যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী করেছেন, তার বিরোধিতা করছে এফবিসিসিআই। তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের প্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে বিদ্যমান শূন্য শুল্ক আরও ৫ থেকে ১০ বছর বহাল রাখা দরকার।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আসছে এটা দেখে যে, বাংলাদেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না।”

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এই বিধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মত দেন তিনি।

বাজেটের আকার বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য

তবে গত কয়েক বছর ধরে বাজেটের আকার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এ বছর ততটা ব্যয় বাড়ানো হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজেটের এই আকারকে ‘বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে মত দিয়েছে এফবিসিসিআই।

তবে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে মন্তব্য করে সংগঠনটির সভাপতি বলেন, “যা মোকাবেলার জন্য সুশাসন ও যথাযথ মনিটরিংয়ের দরকার রয়েছে।”

মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করে এফবিসিসিআই। মাহবুবুল আলম বলেন, “মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে।”

ধান, গম, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ভোজ্য তেল, চিনি, বাদাম প্রভৃতি পণ্যের উপর উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করায় তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই।

বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার, ঋণের সুদের হার, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণের কথাও বলেন তিনি।

সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে মাহবুবুল আলম ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকেও ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করেন।

২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থা প্রচলন, সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের উপর জোর দেওয়াকেও ইতিবাচক বলেন তিনি। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেন তিনি।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বৃদ্ধি বিনিয়োগ বাড়াবে মত দিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, রোবোটিক্স, ডেটা সায়েন্স প্রভৃতিকেও কর অব্যাহতির আওতায় আনা হয়েছে - যা অত্যন্ত ইতিবাচক।”

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানি এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির করপোরেট করহার শর্ত সাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কমিয়ে যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ করায় বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে দেখছে এফবিসিসিআই।

করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লাখ টাকা করার অনুরোধ

বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে এফবিসিসিআই।

এ প্রসঙ্গে সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সরকারকে এই করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লাখ টাকা করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।”

মাহবুবুল আলম বলেন, “কর ফাঁকি বের করতে কর কর্মকর্তাদের পুরস্কার দেওয়া হয়। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা কমানোর জন্য পুরস্কার প্রথা বাতিল করে বিকল্প প্রণোদনার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।”

রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এডিআর সিস্টেম কার্যকর করা, কর ন্যায়পাল নিয়োগ, কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় সদস্যকে ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট করার আহ্বান জানিয়েছিল এফবিসিসিআই।

কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্যকে প্রেসিডেন্ট করার বিধান করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটিও পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

কালোটাকা সাদার পক্ষে বিআইডিএস, তবে... পরবর্তী

কালোটাকা সাদার পক্ষে বিআইডিএস, তবে...

কমেন্ট