ধনীদের করে ছাড় দিয়ে অর্থবিল পাস
১ জুলাই সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ ধাপে করহার ২৫ শতাংশই থাকছে; অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবে এটি ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন।
আয়করে ধনীদের ছাড়, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহারসহ আরও কিছু পরিবর্তন এনে জাতীয় সংসদে অর্থবিল বিল ২০২৪ পাস হয়েছে।
১ জুলাই সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ ধাপে করহার ২৫ শতাংশই থাকছে; অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবে এটি ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন।
তবে বেশি আয় যারা করছেন তারা আয়করের এক বছর ছাড় পাবেন। পরের ২০২৫-২৬ করবর্ষ থেকে সর্বোচ্চ করধাপ ৩০ শতাংশই হবে।
শনিবার এ সংশোধন গ্রহণ করে জাতীয় সংসদে অর্থ বিল ২০২৪ পাস হয়েছে। এতে করভার লাঘবে এ পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালেও ধনীদের করহার কমিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী। বাজেটে সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও অর্থবিল পাসের সময় তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে আগের মতোই সর্বোচ্চ করহার থাকবে ২৫ শতাংশ। এতে ধনীদের কর কম দিতে হবে। এ ছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগ–সংক্রান্ত প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। তাতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়। আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত এই বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ আর অর্থনীতির বাস্তবতায় নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি থাকলেও তাতে সাড়া দেননি অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী। তবে কর ধাপে পরিবর্তন এনে তিনি মধ্যম সারির করদাতাদের কিছুটা ছাড় দিয়েছেন।
অর্থ আইন অনুযায়ী, সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হবে না। পরবর্তী ১ লাখ টাকা আয়ে কর দিতে হবে ৫ শতাংশ হারে। আগে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পরবর্তী ৩ লাখ টাকা আয়ের উপর ১০ শতাংশ হারে কর দেওয়া লাগত। এখন সাড়ে ৪ লাখ টাকা পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে ওই হারে কর দিতে হবে।
পরের ধাপে সাড়ে ৮ লাখ টাকা পরবর্তী ৫ লাখ টাকার আয়ের জন্য কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ হারে। এখন সাড়ে ৭ লাখ টাকা পরবর্তী ৪ লাখ টাকার উপরে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী সাড়ে ১১ লাখ টাকা পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এবার সাড়ে ১৩ লাখ টাকা পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য আয়কর দিতে হবে ২০ শতাংশ হারে।
এরপর সাড়ে ১৮ লাখ টাকা পরবর্তী অবশিষ্ট যে কোনো পরিমাণ আয়ের উপর কর দিতে হবে ২৫ শতাংশ হারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছর এবং পরের ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সাড়ে ১৮ লাখ টাকা পরবর্তী অবশিষ্ট যে কোনো পরিমাণ আয়ের উপর ৩০ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন।
অর্থবিলে এই প্রস্তাবের সংশোধন এনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাড়ে ১৮ লাখ টাকা পরবর্তী অবশিষ্ট যে কোনো পরিমাণ আয়ের উপর ২৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছে।
তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সাড়ে ১৮ লাখ টাকা পরবর্তী অবশিষ্ট যে কোনো পরিমাণ আয়ের উপর ৩০ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে মূলধনী যন্ত্র আমদানি শুল্কমুক্তই থাকছে
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন। এতদিন এই শুল্কহার শূন্য। অর্থাৎ কোনো এক্ষেত্রে কোনো আমদানি শুল্ক দিতে হতো না।
পাস হওয়া অর্থবিলে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে আগের শূন্য শুল্কহারই বহাল রাখা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবের পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআিইসহ অন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলেছিল, কর অবকাশ সুবিধার কথা জেনেই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এসেছে। ১ শতাংশ শুল্কারোপ সেই বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
প্রস্তাবিত বাজেটের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতার শেষে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ সমীচিন নয়। আমি অর্থমন্ত্রীর কাছে আগের মত মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক শূন্য শতাংশে রাখতে বিবেচনার অনুরোধ করছি।”
তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদে উক্ত প্রস্তাবনা উত্থাপনের পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃক ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়েছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা, বিদেশি বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় করা, বিনিয়োগের স্থান বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা এবং সর্বোপরি নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে পূর্বের ন্যায় সমুদয় শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা বজায় রাখা সমীচিন।”
সরকার প্রধান বলেন, “প্রণীত বাস্তবতায় অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবিস্থত শিল্প ইউনিট এবং হাইটেক পার্কে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্মাণ সামগ্রী মুলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে প্রস্তাবিত ১ শতাংশ কাস্টম শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহর পূর্বক পূর্বের ন্যায় শূন্য শতাংশ বহাল রাখা সমীচিন বলে প্রতীয়মান হয়।”
“এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে নিয়োগ প্রাপ্ত ডেভেলপার কর্তৃক উন্নয়ন কার্যব্যবহার্য পণ্য আমদানিতে যথাক্রমে ১ শতাংশ ও ৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক প্রত্যাহার পূর্বক পূর্বের ন্যায় শুন্য বহাল রাখা সমীচিন বলে আমি মনে করি।”
“এ জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা দরকার। এটা আনা হবে। আমি আশা করি অর্থমন্ত্রী এটা গ্রহণ করবেন।”
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রেখেই অর্থবিল সংসদে পাস হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রশ্ন ছাড়া জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া কর অনুযায়ী সেগুলো বৈধ করা যাবে।
এর ফলে আগামী জুলাই থেকে এক বছরের জন্য কালোটাকা সাদা করার সুযোগ পাবেন আগ্রহীরা।
বিনাপ্রশ্নে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করতে পারবে।
বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সংশোধনের প্রস্তাব আনেন সংসদ সদস্যরা। এরমধ্যে আয়করে ব্যক্তির সর্বোচ্চ করধাপ ৩০ শতাংশের পরিবর্তে আগের মতই ২৫ শতাংশ থাকছে।
এর আগে বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী করহারের ধাপে কিছুটা পরিবর্তন এনে সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলেন।
অন্যদিকে অর্থবিলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় পেনশন বাবদ যেকোনো আয় এবং পেনশন স্কিমে প্রদত্ত যেকোনো পরিমাণ চাঁদা করের আওতামুক্ত রাখার প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।
একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে, কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির জন্য এই বিধান প্রযোজ্য হবে না বলে অর্থ বিলে সংশোধন আনা হয়েছে।
এছাড়া আগের করবর্ষের তুলনায় অন্যূন ১৫ শতাংশ অধিক আয় কেউ যদি রিটার্নে প্রদর্শন করেন, তাহলে তাকে অডিটের আওতামুক্ত রাখা হবে। অর্থ বিলে এমন বিধান যুক্ত করে তা পাস করা হয়েছে।
কেবল সিটি করপোরেশনে অবস্থিত কোনো কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল ভাড়া নিলে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি সকল স্থানের কমিউনিটি সেন্টার বা কনভেনশন হল ভাড়ার ক্ষেত্রে করা হয়েছিল।
কমেন্ট