কালোটাকা সাদার সুযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল
গত ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আনুষ্ঠানিভাবে বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিতর্কিত এই সুযোগ কার্যকর হওয়ার ঠিক দুই মাসের মাথায় এটি বাতিল করা হলো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সোমবার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এই সুবিধাটি বাতিল করা হয়।
গত ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
গেজেট প্রকাশের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর জানায়, ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপদ্রর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শন করার বিধান অর্থ আইন ২০২৪ এর মাধ্যমে সংযোজন করা হয়েছিল।
একজন নিয়মিত করদাতাতে তার আয়ের উপর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান করতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রদেয় করের আরও সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ হারে সারচার্জ প্রদান করতে হয় বিধায় মাত্র ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদান কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমাতাভিত্তিক কর ব্যবস্থার জন্য বৈষম্যমূলক।
“এমতাবস্থায়, একটি ন্যায়ভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন (এসআরও নং ৩০৩-আইন/আয়কর-৪৬/২০২৪, তারিখ: ০২/০৯/২০২৪) দ্বারা, ১৫% আয়কর পরিশোধ করে নগদ অর্থসহ অপ্রদর্শিত সমজাতীয় পরিসম্পদ প্রদর্শনের বিশেষ ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হলো।”
“জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি সত্যিকারের বৈষম্যমূলক, ন্যায়ানুগ ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, “কালোটাকা সাদা করার বিধি এবং রীতি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ এ জায়গা থেকে সরকার যতটুকু টাকা আনতে পারে সে টাকা দিয়ে সরকারের বেশি কিছু আগায় না। বরং মূল্যবোধটা অনেক বেশি অবক্ষয় হয়। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে।”
কবে থেকে কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল বন্ধ হবে—এ প্রশ্নের উত্তরে রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, “এ বিষয়ে একটা ব্যাখা এবং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা আদেশের মাধ্যমের বলে কালোটাকা সাদা করার কথা বলা হবে না; উল্টো বলা হতে পারে।”
বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেয়। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে এই সুযোগ দেওয়া হয় এক বছরের জন্য।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে যে বাজেট পেশ করেছিলেন, তাতে তিনি এই প্রস্তাব করেন। ৩০ জুন পাস হয় এই বাজেট। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল এর বাস্তবায়ন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের।
কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, “চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা আবশ্যক। অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার নিমিত্তে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে আমাদের অধিক পরিমাণ রাজস্ব জোগান দিতে হবে এবং অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে।
“এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করছি। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনও করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের উপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনও কর্তৃপক্ষ কোনও প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।”
দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়।
এরপরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ সেই সুযোগ নেননি। এক বছর বিরতির পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবারও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বৈধ হয়েছে।
২০০৭ থেকে ২০০৮ সময়ের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। ওই সময়ে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার করদাতা কালো টাকা সাদা করেছিলেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা কর দিয়ে নগদ টাকা সাদা করেছিলেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন।
কর কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমিত হওয়ায় ওই বছর মানুষ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন বেশি।
কমেন্ট