অর্থ সংকটে ৬ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন মাত্র ১৮%
এর আগে কখনই ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের এমন হাল দেখা দেয়নি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপিতে মোট বরাদ্দের ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ খরচ হয়েছিল।
অর্থ সংকটে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে বেহাল দশা দেখা দিয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়নের এই হার ইতিহাসে সবচেয়ে কম।
এর আগে কখনই ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের এমন হাল দেখা দেয়নি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপিতে মোট বরাদ্দের ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ খরচ হয়েছিল।
করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছিল; কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। সে কারণে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মন্থরগতি দেখা দিয়েছিল।
জুলাই অভ্যুত্থান ও এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ঢালাওভাবে খরচ করতে না চাওয়ায় এডিপির আওতায় সেই কর্মকাণ্ড আরও চাপে পড়েছে। তবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে তা ঘুরে দাঁড়িয়েছ; এই এক মাসেই বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ।
ডিসেম্বর মাসের সফলতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অনুমোদন পাওয়া এডিপি বরাদ্দের প্রায় ১৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে সরকার।
এর আগে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৩৪ হাজার ২১৪ বা ১২ শতাংশের কিছু বেশি বাস্তবায়ন হয়েছিল। সেখান থেকে ডিসেম্বর এক মাসেই প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা বাস্তবায়ন করে তা ৫০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের এই ব্যয় এডিপি বাস্তবায়নে অর্থ ব্যয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে কম।
এর আগে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ২২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম বাস্তবায়ন হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের সর্বশেষ যে প্রতিবেদন মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে, সেখানে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বিগত সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে, বৈদেশিক ঋণ থেকে এক লাখ কোটি টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার কথা রয়েছে।
ডলার সংকটে আওয়ামী লীগ সরকার শেষ মেয়াদে বেছে বেছে বিদেশি ঋণ সহায়তার প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। ফলে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই সংকুচিত হতে থাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এবং শেখ হাসিনার সরকার পতন-পরবর্তী সময় সৃষ্ট অস্থিরতায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যাচাই-বাচাই করে অর্থছাড়ের কথা জানায়।
ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে এডিপি বাস্তবায়ন অনেক কমে যাবে—এই আন্দাজ আগেই করা হচ্ছিল। তবুও ডিসেম্বরে এসে তাতে গতি পেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি মাস থেকে পরের ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের গতি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সম্প্রতি একনেক বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে প্রকল্পের ব্যয় এবং যৌক্তিকতা নিয়ে যাচাই বাচাই করা এবং চলমান অনেক প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন থাকায় বাস্তবায়ন গতি শ্লথ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “আমরা পহেলাতেই প্রকল্পগুলো যাচাই-বাচাই করছিলাম। এখন থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুততর হবে।”
কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত হবে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই একনেকের মিটিংয়ে অনেক দ্রুত এবং বেশি (দশটি) প্রকল্প অনুমোদন করেছি। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক দ্রুততর হবে।
“তার একটা কারণ হলো- বেশ কিছু প্রকল্প এখন আসছে, যেগুলা আমাদের সময়ের নতুন প্রকল্প। আগেরগুলো অনেক যাচাই-বাচাই করতে হচ্ছিল, ফেরত পাঠাতে হচ্ছিল, আবার সংশোধন করতে হচ্ছিল। এই প্রথম আমাদের নিজেদের নতুন প্রকল্পগুলো আসা শুরু করেছে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের।”
“আমি স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই ধরনের প্রকল্প পাঠাতে বিশেষ অনুরোধ করেছি। পরিকল্পনা কমিশনকেও বলেছি অনুসন্ধান করে স্থানীয় ধরনের প্রকল্প কোনগুলো আছে, সেগুলো খুঁজে বের করার জন্য”, বলেন উপদেষ্টা।
তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাস্তবায়ন ১ শতাংশের কম
অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ বরাদ্দ ব্যয় করতে পেরেছে।
এর মধ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ৭ কোটি টাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়ার বিপরীতে খরচ করতে পেরেছে মাত্র ৪৭ লাখ টাকা এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ৭৫৪ বোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে খরচ করতে পেরেছে মাত্র ৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাস্তবায়ন ১০ শতাংশের কম
এডিপি বাস্তবায়নে জড়িত ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বরাদ্দের বিপরীতে ১০ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হচ্ছে- নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
এছাড়া পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, নির্বাচক কমিশন সচিবালয় এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের বাস্তবায়ন ১০ শতাংশের কম।
বড় ১৫ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন গড় ২০ শতাংশ
বেশি বরাদ্দ পাওয়ার ভিত্তিতে বড় ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় ২০ শতাংশ বরাদ্দ ব্যয় করতে পেরেছে।
এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ সর্বোচ্চ ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রায় ২৬ শতাংশ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সমান ২১ শতাংশ হারে বাস্তবায়ন করেছে।
পানি সম্পদ ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৮ শতাংশ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করেছে।
এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ দশমিক ৬০ এবং সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ ১৬ শতাংশ, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ প্রায় ৯ শতাংশ, সেতু বিভাগ মাত্র ৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।
বড় মন্ত্রণালয়গুলোরে মধ্যে দেশের জনসাধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে সবচেয়ে কম মাত্র ৫ শতাংশেরও কম।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সে কারণে বিদায়ী সরকারও কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নিয়েছিল।
“এরই মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই ঘিরে আন্দোলন, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে পাঁচ মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে তা আদায় করতে না পারায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল।
কিন্তু এবার অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ঘাটতি তার দ্বিগুণ হওয়ায় পুরো বছর শেষে ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সরকারের চিন্তার জন্য যথেষ্ট।
এই ঘাটতি পূরণে অর্থ বছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক), শুল্ক ও কর বাড়িয়েছে অন্তবর্তী সরকার। যা নিয়ে এখন সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
কমেন্ট