৬ মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা
শুধু তাই নয়, গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই ছয় মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (ছয় মাস, জুলাই-ডিসেম্বর) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
শুধু তাই নয়, গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই ছয় মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রাজস্ব আদায়ে এমন নাজুক অবস্থা দেখা যায়নি। অর্থবছর শেষে ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—তা নিয়ে চিন্তিত সরকার।
এই ঘাটতি পূরণে অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক), শুল্ক ও কর বাড়িয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। আন্দোলন ও সমালোচনার মুখে ওষুধ ও রেস্তোরাঁ খাতের সঙ্গে মোবাইল ফোন, পোশাক, আইএসপি, মিষ্টি, নন–এসি হোটেল এবং গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ সেবায় অতিরিক্ত যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছিল তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ এ সব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক আগের হারই বহাল থাকবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সংক্রান্ত চারটি প্রজ্ঞাপন জারির কথা জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এতে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে না।
২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরু হয় গত বছরের ১ জুলাই থেকে। ওই মাস থেকেই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাসের প্রায় পুরোটা সময় দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তারসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। এর পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরও দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে পাঁচ মাস হতে চললেও দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চতার কারণেই সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা লেগেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের কর্মকর্তারা।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই–ডিসেম্বর সময়ে মোট ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে এই ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বা ৬ শতাংশ রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
অর্থবছরের প্রথমার্ধের রাজস্ব আদায়ের যে চিত্র, তাতে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশের বর্তমান পেক্ষাপটে বছর শেষে লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না এনবিআর। কেননা, অর্থবছরের অর্ধেক সময়ে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ বা সাড়ে ৩২ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআরের।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শুল্ক-কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। জুলাই-ডিসেম্বরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।
এই ছয় মাসে আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন খাতের মধ্যে কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। এ খাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। তার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানি খাতে ৬১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে ৪৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ভ্যাট বাবদ আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। এ সময়ে এ খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
এই ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার হয়েছে ক্ষমতার পালাবদলের মাস অগাস্টে। ওই মাসে তিন দিন সরকারবিহীন ছিল দেশ, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি দেশে।
সরকার পতনের পর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটির সদস্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার পরিবেশ ছিল নাজুক। ব্যবসায়ীরা শুল্কায়ন করেও মাল খালাস ও গুদামে বা উৎপাদনস্থলে আনার সাহস করছিলেন না।
যার প্রতিফলন দেখা গেছে অগাস্ট মাসের রাজস্ব আদায়ে। এ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
আন্দোলনের মাস জুলাইয়েও ‘অস্থির’সময় দেখেছে দেশ। সংঘাত, কারফিউ ও ইন্টারনেট ব্লাকআউটের ফলে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় ১০ দিনের জন্য স্থবির ছিল। উৎপাদন ও সরবরাহও ব্যহত হওয়ায় এ মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ১২ শতাংশ কম হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি অবশ্য তুলনামূলক ভালো ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর এ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির খবর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে আসছিল; ছয় মাসেও এ ধারা থেকে বের না হওয়ার তথ্য এল এবার।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব বোর্ড- গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ০৩ শতাংশ কম রাজস্ব আহরণ করে, যেখানে আগের বছর একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
একমাস আগে প্রথম প্রান্তিক তথা জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ শতাংশ কম রাজস্ব আদায় করতে পারার তথ্য এসেছিল। ওই সময় রাজস্ব আদায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কম হয়েছিল।
একমাস বিবেচনায় গত অর্থবছরের অক্টোবর থেকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে রাজস্ব আদায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ বাড়লেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি।
আমদানি, রপ্তানি ও উৎপাদনসহ অর্থনীতির সকল সূচক যখন ধীরগতিতে চলছে, তখন এসবের বিপরীতে রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ মাসের হিসাবে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে সেই ঘাটতির অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
সবশেষ ডিসেম্বর শেষে অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথমার্থে (জুলাই-ডিসেম্বর) ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ভোগ কমে যাওয়ায় ভ্যাট আদায়ে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
আন্দোলন, সংঘাত, ক্ষমতার পালাবদলের পাশাপাশি বন্যার কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকটের ধাক্কা কাটিয়ে জুলাই-অগাস্টের পর সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নেমে এলেও আবার তা বেড়ে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে।
সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো—২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, গত বছরের ডিসেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছিল বাংলাদেশ। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।
অক্টোবর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ও কর, অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন, বছরের শেষের দিকে কর আদায়ে গতি বাড়বে। তবে নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাও কঠিন হবে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ধারাবাহিকতায় এনবিআরেরও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি।
এই কমিটির সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে ও পরে দেশের পরিস্থিতি তো আসলেই অস্থির ছিল। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এমনিতেই অর্থবছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি থাকে। তারপর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এবার আদায় আরও কমে গেছে।”
“রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে ব্যবসা–বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ও বিঘ্নিত হয়েছে। আয়করও কম আদায় হয়েছে। এসব কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে,” বলেন তিনি।
কমেন্ট