মূল্যস্ফীতি প্রায় ‘দুই অঙ্কের’ ঘরে

মূল্যস্ফীতি প্রায় ‘দুই অঙ্কের’ ঘরে

মূল্যস্ফীতির পার চড়ছেই; একলাফে অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এর অর্থ হলো ২০২২ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের মার্চে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এপ্রিলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে তাদের লেগেছিল ১০৯ টাকা ২৪ পয়সা।

মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়স সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি ছুঁটছে।

বিবিএসের তথ্য বলছে, মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ

এই মাসে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

মে মাসে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পরই তা দুই অঙ্কের নিচে নেমে আসে। এরপর ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

আগস্টে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। এর পর এপ্রিল পর্যন্ত এই সূচক ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। মে মাসে তা এক লাফে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে।

সেই হিসাবে মে মাসের মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এ রকম এক সময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়।

যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে।

তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকার কারণে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।

খাদ্যে মূল্যস্ফীতি

বিবিএসের তথ্যমতে, মে মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। মার্চে হয়েছিল ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।

জানুয়ারিতে ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি

মে মাসেমার্চে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ; ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এপিলে হয়েছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। মার্চেও এই হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ৮.৮৪ শতাংশ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, ১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে মাস) দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

অথচ বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বাজারের যে অবস্থা তাতে মে মাসের মতো অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমূখী থাকবে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সে বিবেচনায় অর্থবছর শেষ গড় মূল্যস্ফীতি বাজেটের লক্ষ্যের অনেক উপরে থাকবে।

অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছেন।

দেশের বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে।

বাজেট ঘোষণার পর থেকেই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে।

মজুরি সূচক বেড়েছে

বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সর্বশেষ জানুয়ারিতে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

মার্চ মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ৭ দমিক ২৩ শতাংশ।

সর্বশেষ মে মাসে মজুরি সূচক আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।

 

 

 

 

 

পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে শুরু করেছে, দেশে ঢুকছে ভারতের পেঁয়াজ পূর্ববর্তী

পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে শুরু করেছে, দেশে ঢুকছে ভারতের পেঁয়াজ

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখতে চান অর্থমন্ত্রী পরবর্তী

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখতে চান অর্থমন্ত্রী

কমেন্ট