পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে শুরু করেছে, দেশে ঢুকছে ভারতের পেঁয়াজ
বেনাপোল বন্দর দিয়ে রাতে ঢুকেছে পেঁয়াজবোঝাই তিনটি ট্রাক। ছবি: এআরএইচ ডটকম
আমদানির অনুমতির পর দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সোমবার দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দর ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
তবে খুচরা বাজারে এর প্রভাব তেমন দেখা যায়নি। দু-একদিনর মধ্যেই কমবে বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী রিপন কুমার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমদানির খবরে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে বলে শুনেছি। ভারত থেকে প্রচুর পেঁয়াজ আসছে। আমরা আগের দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করছি। কম দামের পেঁয়াজ এখনও আমাদের দোকানে আসেনি। আসলে আমরা কম দামে বিক্রি করবো।”
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, সোমবার ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রোববার এই পেঁয়াজের কেজি ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা।
এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। আর গত মাসের এই সময়ে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে ৪০ টাকার মতো বেড়েছে।
টিসিবির তথ্যমতে, গত বছর এই সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।
বর্তমানে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি উন্মুক্ত থাকায় পেঁয়াজ আমদানি বেশি হয়েছিল। তখন দেশি পেঁয়াজের বাজারদর কম ছিল, প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল। কৃষকেরা কম দাম পেয়েছিলেন। সে জন্য পেঁয়াজ চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে এবার আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পর পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে এক থেকে দুদিনের মধ্যে দেড়শ থেকে ১৮০ টাকায় উঠে যায়। এরপর সপ্তাহ না হতেই দাম বেড়ে আড়াইশ টাকায় উঠে যায় পেঁয়াজের কেজি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওটাই ছিল পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দর। নতুন পেঁয়াজ ওঠায় পরে অবশ্য তা কমে আসে।
মাস খানেক ধরে পেঁয়াজের ফের বাড়তে থাকে। সোমবার এর কেজি ১০০ টাকায় গিয়ে ওঠে।
এই দামের লাগাম টেনে ধরতে গত দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত রোববার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সোমবার থেকেই পাশের দেশ ভারতের পেঁয়াজ বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে দেশে ঢুকতে শুরু করেছে।
রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবসহ ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, সোমবার সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে মোট ২১০টি আমদানি অনুমতিপত্র (ইমপোর্ট পারমিট বা আইপি) ইস্যু করা হয়েছে। এসব আইপির বিপরীতে সরকার এক দিনে সর্বমোট ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
তবে আইপিতে টেকনিক্যাল ত্রুটি থাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ সোমবার সকাল থেকে বন্দর দিয়ে দেশের ভেতরে আনা যায়নি।
অবশ্য বিকেল থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ দিয়ে শুরু হয়েছে পেঁয়াজ আমদানি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বন্দরে পেঁয়াজবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে বলে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার প্রভাত কুমার সিংহ। তিনি জানান, বিকেল থেকে পেঁয়াজবাহী ট্রাক প্রবেশ শুরু করেছে। আইপি অনুমোদন পাওয়া নথিপত্র পেলেই ট্রাক প্রবেশের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
পেঁয়াজ আমদানিকারক মাসুদ রানা জানান, সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয়ার পর থেকেই আমরা কার্যক্রম শুরু করি। বিকেলের দিকে আমদানি শুরু হয়েছে। কয়েকজন আমদানিকারক পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন পেয়েছেন।
আমাদের বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রাত ৮টার দিকে ৭৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নিয়ে তিনটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জারিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান এর আমদানিকারক।
সোমবার দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ৬০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে রোববার আমদানি অনুমতি দেয়ার ঘোষণার আগ পর্যন্ত এই বাজারে ৯০ টাকা পাইকারি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল।
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রোববারই কেজিতে ২০ টাকা কমে পণ্যটির দাম। এক দিন পেরোতেই আরও ১০ টাকা দাম কমে গেছে।
চাকতাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, “আমদানির অনুমতির খবর ছড়িয়ে পড়ায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা রোববার ২০ টাকা ও সোমবার আরও ১০ টাকা দাম কমিয়েছে। এখন ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, তাতেও ক্রেতা নেই। সবাই আমদানির অপেক্ষা করছে হয়তো।”
পেঁয়াজসহ ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমদানিকারকদের দুষেন এই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “পেঁয়াজ, আদাসহ সব পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য আমদানিকারকরাই দায়ী। তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।”
আবুল কাসেম বলেন, “আইপি (অনুমতিপত্র) চট্টগ্রামে আসতে সময় লেগেছে। আমদানিকারকরা আইপি পেয়েছে ৩টায়। সোমবার কিছু পেঁয়াজ ঢুকতে পারে। মঙ্গলবার থেকে পুরোদমে ঢুকবে। আমদানির পর আরও কমবে পেঁয়াজের দাম। তবে এতে পেঁয়াজচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যারা অতিরিক্ত পেঁয়াজ মজুত করে রেখেছেন, তারাও বিপদে পড়বেন।”
এদিকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে খুচরা বাজারেও ১৫ থেকে ২০ টাকা কমেছে পণ্যটির দাম। বর্তমানে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে ৮০ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
সোমবার নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকার কর্ণফুলী মার্কেটে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আহমদীয়া ট্রেডার্সে ৮০ টাকা, এসএস মার্টে ৮৫ টাকা, কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ৯৫ টাকা ও কর্ণফুলী ট্রেডার্সে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
একইভাবে নগরীর অক্সিজেন এলাকার আনয়ার স্টোর ও পাঁচলাইশ এলাকার উৎসব সুপারশপে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি।
গত রমজানের পর থেকে দেশের বাজারে হুহু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। কয়েক দফা বেড়ে দেশের বাজার প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হতে থাকে, পাইকারি বাজারে যা ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত।
গত বছর চাহিদার চেয়ে অধিক আমদানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন পেঁয়াজচাষিরা। তাই চাষিদের পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত করতে এবার পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল সরকার।
কমেন্ট