কারওয়ান বাজার ছাড়বেন না ব্যবসায়ীরা, করণীয় ঠিক করতে কমিটি
কারওয়ান বাজার। ফাইল ছবি
রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কারওয়ান বাজার ছাড়তে চান না ব্যবসায়ীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা এই বাজারেই ব্যবসা করতে চান। নতুন স্থানে অনেক সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা কিছুতেই এখান থেকে যাবেন না।
মেয়র আতিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার এক মত বিনিময় সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম কারওয়ান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ জানালে তারা কোনো অবস্থায়ই ওই স্থান ছাড়বেন না বলে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন।
কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবন মিলনায়তনে ওই সভায় ব্যবসায়ীরা কারওয়ান বাজার না ছাড়ার বিষয়ে তাদের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন। সরানোর চেষ্টা করা হলে প্রয়োজনে আত্মাহুতিরও হুমকি দিয়েছেন তারা।
মতবিনিময় সভার শেষে সভাপতির বক্তব্য দেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। কারওয়ান বাজারের ঝুঁকি, স্থানান্তরের যৌক্তিকতা এবং এর ফলে ব্যবসায়ীরা যেসব সুবিধা পাবেন, সেগুলো তুলে ধরেন তিনি। তখন মিলনায়তনের যে অংশে আড়ত ও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বসা ছিলেন, সেদিক থেকে উচ্চ স্বরে বলতে শোনা যায়, তারা কারওয়ান বাজারেই থাকবেন। দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও থাকবেন। এমনকি দুর্ঘটনার দায়ও নেবেন।
মেয়রের বক্তব্য চলাকালে অন্তত তিন দফায় ব্যবসায়ীরা এভাবে উচ্চ স্বরে স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানান দেন। এ সময় মেয়র আতিককে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ব্যবসায়ীদের শান্ত করে আবার বক্তব্য শুরু করতে দেখা যায়।
বাজার স্থানান্তরের যৌক্তিকতা তুলে ধরে আতিকুল ইসলাম বলেন, “মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ লিখে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছিল। সেটা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। এই মার্কেট যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। তখন এর দায়িত্ব কে নেবে? ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শহরের ভেতরে কি পাইকারি বাজার হতে পারে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন যদি শহরের ভেতরে আর ট্রাক ঢুকতে দেওয়া না হয়, তখন তো ব্যবসায়ীদেরই সমস্যা হবে।”
মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশন যে মার্কেট করে দিচ্ছে, তা কারওয়ান বাজারের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ভালো হবে। মেয়রকে তখন কথা বলতে না দিয়ে ব্যবসায়ীরা বলতে থাকেন, যাত্রাবাড়ীতে যাবেন না। কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকবেন।
এই পর্যায়ে মেয়র বলেন, “কারওয়ান বাজার মার্কেট যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। এই দায়িত্ব তখন আপনাদেরই নিতে হবে।”
তখন ব্যবসায়ীদের দিক থেকে উচ্চ স্বরে জবাব আসে, দায়িত্ব নিলাম, আমরা দায়িত্ব নিলাম। ভাঙলে সব দায়িত্ব আমাদের।
এরপরই আবার কয়েকজন ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে এই পরিস্থিতির জন্য মেয়রকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, প্রায় এক দশক আগে মার্কেট সংস্কার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আর এখন বলা হচ্ছে, মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।
এভাবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সভা শেষ হয়। মেয়র বক্তব্য শেষ করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ওই কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কাওয়ান বাজার থেকে মার্কেট স্থানান্তরের জন্য করণীয় নিয়ে সিটি করপোরেশনকে প্রতিবেদন জমা দেবে।
এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে অবশ্য বক্তব্য দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “প্রকৌশলীরা এই বাজারের কয়েকটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে, ব্যবসায়ীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। পাশ দিয়ে মেট্রোরেল হচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। একসময় হয়তো কারওয়ান বাজারে ট্রাক আসবে না। ব্যবসায়ীদের এটি আগে থেকেই বিবেচনা করতে হবে।”
ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখেই এখান থেকে বাজার সরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তাজুল ইসলাম বলেন, “মার্কেট স্থানান্তরের সঙ্গে অনেকের জীবন–জীবিকার বিষয় জড়িত। কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই উন্নয়নকাজে ধ্বংস ও নির্মাণ হয়েছে। তবে কাউকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিন্তা না করে একপক্ষ হিসেবে চিন্তা করতে হবে।”
মতবিনিময় সভার শুরুতে ব্যবসায়ীরা বক্তব্য রাখেন। প্রায় সবাই বলেন, তারা কারওয়ান বাজার থেকে যেতে চান না। যে কোনো উন্নয়ন কাজই করা হোক, ব্যবসায়ীদের সেখানে রেখেই করতে হবে।
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন বলেন, “সেখানে দুই হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। কারওয়ান বাজার স্থানান্তর করলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দাবি, আমরা যেন এখানেই থাকতে পারি সে ব্যবস্থা করা হোক।”
প্রয়াত আনিসুল হক ঢাকা উত্তরের মেয়র থাকার সময়ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সরানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। মহাখালীতে ডিএনসিসি মার্কেটও তৈরি হয় তাদের স্থানান্তরের জন্য। তবে ব্যবসায়ীরা সরতে রাজি হননি।
সম্প্রতি ঢাকায় কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার কথাও আসে আলোচনায়।
কমেন্ট