জ্বালানি তেলের দামে ধস, ফিরেছে যুদ্ধের আগের দরে
ফাইল ছবি
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি সুখবর এসেছে। যে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতিতে ওলোটপালট করে দিচ্ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। ফিরে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু আগের দরে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১২টায় ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ১২ শতাংশ বা ৩ ডলার ৮ সেন্ট কমে ৭১ ডলার ৭১ সেন্টে নেমে এসেছে।
এই দর ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পর সবচেয়ে কম। অর্থাৎ দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করে। এর পর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১৩৯ ডলারে উঠে।
এর পর অবশ্য বেশ কিছু দিন তেলেল দাম ১০০ থেকে ১২০ ডলারের মধ্যে উঠানামা করছিল। এপ্রিল মাসের দিকে এই তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসে।
টানা দুই সপ্তাহ ধরে কমছে তেলের দাম। সোমবার সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। এমনকি গত সপ্তাহে সৌদি আরব নিজে থেকে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেও বাজারে তেলের দামের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।
মূলত চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কমে যাওয়ার কারণে তেলের চাহিদা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রয়টার্স বলছে, সোমবার রাত ১২ টার আগে ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৩ ডলার ২১ সেন্ট কমে ৬৬ ডলার ৯৬ সেন্টে নেমে এসেছি।
জ্বালানি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সপ্তাহের শেষের দিকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের মূল্যস্ফীতির তথ্য এবং ফেডারেল রিজার্ভের বৈঠকের ঠিক আগে বিশ্লেষকরা ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সরবরাহ এবং চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ তুলে ধরার পরে সোমবার তেলের দামে বড় পতন হয়েছে।
এদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সংবাদে বলা হয়েছে, বাজেট-ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে অপরিশোধিত তেলের দর প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারের ওপরে রাখা সৌদি আরবের জন্য জরুরি।
যদিও গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এসব করে সৌদি আরব তেলের দাম বড়জোর ১ থেকে ৬ ডলার বাড়াতে পারে। কিন্তু তাতে ভোক্তাদের তেমন কিছু আসবে–যাবে না, অথবা যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের দাম সে কারণে রাজনৈতিকভাবে হুমকিতে পড়বে না। কারণ, সে দেশের পাম্পগুলোয় তেলের দাম এমনিতেই গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম।
বিশ্লেষকেরা বলেন, রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি চাঙা রাখতে বাজারে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ছাড়ছে। ফলে বাজারে তেলের অভাব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে, বিশেষ করে চীনের শ্লথগতির কারণে তেলের দাম তেমন বাড়ছে না।
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ কের দেয় সরকার। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।
সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলে আসছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কাছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
২০২১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এর পর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে'তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
কমেন্ট