আমদানি করা পেঁয়াজের মান ভালো না, কিনছে না কেউ
ফাইল ছবি
চড়তে থাকা পেঁয়াজের দামের লাগাম টেনে ধরতে আমদানির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তাতে খুব একটা কাজে আসছে না। কমছে না দেশি পেঁয়াজের দাম; এখনও ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ দেশে আসার পর থেকেই এই দামে বিক্রি হচ্ছে। কমার কোনো লক্ষণ নেই।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোরবানি ঈদের আগে দেশি পেঁয়াজের দাম কমবে না। উল্টো বাড়তে পারে।
বাজারে আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। তবে এই পেঁয়াজের মান ভালো না হওয়ায় কেউ কিনছে না। চাহিদা না থাকায় সব দোকানদার এই পেঁয়াজ বিক্রিও করছে না।
অন্য পণ্যের মধ্যে সবজির দামও বেড়েছে। গত দুই সপ্তাহ কিছুটা কম দামে শাক-সবজি বিক্রি হলেও আবার বেড়েছে দর। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আদা-রসুনসহ মশলা জাতীয় অন্য সব পণ্যের দাম বেড়েছে। চীনের আমদানি করা আদা বাজারে মিলছে না; দেশি আদা ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমানোর যে ঘোষণা দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাজারে সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে।
তবে চিনি বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত চিনি বাজার থেকে উধাও সেই কবে থেকে; কোনো বাজারেই মিলছে না। খুচরা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি দরে।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার, হাতিরপুল ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
শেওড়াপাড়া বাজারের মেসার্স মুনা ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী আবুল হাশেম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আজ আমরা ৭৫ টাকা কেজিতে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছি। ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজের মান খুবই খারাপ; কেউ কিনতে চায় না। সে কারণে দোকানে রাখি না।”
পাশের দোকানে ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজ দেখতে পাওয়া যায়। দোকানদার রিপন বস্তা থেকে কয়েকটি পেঁয়াজ উঁচু করে দেখিয়ে বলেন, “এই পেঁয়াজ বড় বড়। খোসা উঠানো কেমন যেনো দেখতে কালো-সাদা মিলিয়ে। কেউ এ পেঁয়াজ কিনতে চায় না।”
সে কারণেই দেশি পেঁয়াজের চাহিদা কমেনি। দামও কমছে না। আমদানি শুরু হলে দাম কমবে বলে সবাই যে ধারনা করেছিল, সেটা মনে হয় না হবে। উল্টো ঈদকে সামনে রেখে দাম ফের বাড়তে পারে,” বলেন রিপন।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) বলছে, শুক্রবার ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।
সপ্তাহ দু’য়েক আগে টানা বাড়তে বাড়তে দেশি পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকায় উঠেছিল। আর গত মাসের এই সময়ে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
টিসিবির তথ্যমতে, গত বছর এই সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসেও ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছিল পেঁয়াজ। গত মাসে হঠাৎ দাম বাড়তে শুরু করে। তারপর সপ্তাহ ব্যবধানে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেজি প্রতি বাড়তে থাকে। পাশাপাশি এ মাসেই কোথাও কোথাও সেঞ্চুরি অর্থাৎ ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় মসলা জাতীয় এ পণ্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।
বর্তমানে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি উন্মুক্ত থাকায় পেঁয়াজ আমদানি বেশি হয়েছিল। তখন দেশি পেঁয়াজের বাজারদর কম ছিল, প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল। কৃষকেরা কম দাম পেয়েছিলেন। সে জন্য পেঁয়াজ চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে এবার আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়
২০১৯ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পর পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে এক থেকে দুদিনের মধ্যে দেড়শ থেকে ১৮০ টাকায় উঠে যায়। এরপর সপ্তাহ না হতেই দাম বেড়ে আড়াইশ টাকায় উঠে যায় পেঁয়াজের কেজি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওটাই ছিল পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দর। নতুন পেঁয়াজ ওঠায় পরে অবশ্য তা কমে আসে।
ওই সময় বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মান ভালো না হওয়ায় অনেক পেঁয়াজ মনে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিলেন।
এবার পেঁয়াজের দামের লাগাম টেনে ধরতে দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত গত ৪ জুন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। পরের দিন থেকেই পাশের দেশ ভারতের পেঁয়াজ বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে দেশে ঢুকতে শুরু করেছে।
ওই সময় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবসহ ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল মন্ত্রণালয়।
গত রমজানের পর থেকে দেশের বাজারে হুহু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। কয়েক দফা বেড়ে দেশের বাজার প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হতে থাকে, পাইকারি বাজারে যা ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত।
গত বছর চাহিদার চেয়ে অধিক আমদানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন পেঁয়াজচাষিরা। তাই চাষিদের পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত করতে এবার পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল সরকার।
সবজির দামও চড়া
বেশ কিছু দিন বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বেশ চড়া ছিল। ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি মিলছিল না। কাঁচা পেপের কেজি ১০০ টাকায় উঠেছিল। গত দুই সপ্তাহ অবশ্য তা খানিকটা কমে এসেছিল।
কিন্তু এই সপ্তাহে ফের বাড়তে শুরু করেছে সব ধরনের সবজির দাম।
শুক্রবার রাজধানীর বাজারগুলোতে বেশিরভাগ সবজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে মৌসুম না হওয়ায় দু-একটি সবজি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। শশাও ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে করলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে। সা ৬০ টাকা, বেগুন ৭০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, কাঁচা কলা প্রতি হালি ৫০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ৭০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, গাজর ১০০ টাকা, চাল কুমড়া বা জালি প্রতি পিস ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৫০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শেওড়াপাড়া বাজারে বাজার করতে আসা চাকরিজীবী মাহবুব জামান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমদানি শুরু হলে পেঁয়াজের দাম নাকি কমে ৫০ টাকায় নেমে আসবে। কিন্তু কই? সেই ৭৫-৮০ টাকাতেই তো বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজের দিকে তো তাকানোই যায় না। কেমন জানি দেখতে।”
তিনি বলেন, “মাঝে সবজির দাম কিছুটা কমেছিল। আজ কিনতে এসে দেখলাম ফের বাড়তে শুরু করেছে।”
শেওড়াপাড়া বাজারের সবজি বিক্রেতা উজ্জল বলেন, “কিছুদিন সবজির দাম কিছুটা কম ছিল। এখন সরবরাহ কমে গেছে। সে কারণে দাম একটু বেড়েছে।”
মাছ-মাংসের দাম চড়া, চাল স্থিতিশীল
মাছ ও মাংসের দাম খুব একটা হেরফের হয়নি। গত সপ্তাহের চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায়; খাশির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। মোটা চাল প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) ৭০ থেকে ৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কমেন্ট