সংকটে পশু কোরবানি কমার শঙ্কা

সংকটে পশু কোরবানি কমার শঙ্কা

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে পশু কেনাবেচা। মাঝারি সাইজের একটি গরু সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বিক্রির খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর এই গরু এক থেকে সোয়া লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

রাজধানী ঢাকায় কোরবানির পশুর হাট বসবে ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকে। সেই কেনাবেচা শুরু হলেই বোঝা যাবে প্রকৃত দাম। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এবার পশুর দাম বেশিই হবে।

সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে, দেশে এবার কোরবানিযোগ্য পশু আছে চাহিদার চেয়ে ২১ লাখেরও বেশি। এর পরও এবার পশুর দাম বাড়তির দিকে থাকবে বলে জানিয়েছেন খামারিরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো পশুখাদ্যের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও সার্বিক লালন-পালনের খরচ বাড়ার কারণেই এবার দাম বাড়তির দিকে থাকতে পারে।

দেশের গবাদিপশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকছে বলে দাবি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। তবে গত কয়েক বছরে দেশে পশু কোরবানির সংখ্যা কমেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের সক্ষমতা কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে গবাদিপশুর দাম। মূলত এ দুই কারণে দেশে পশু কোরবানি কমেছে। এবারও তেমনাটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পবিত্র ঈদুল আজহায় ১ কোটি ৬ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়। এর চেয়ে ১১ লাখ ৬৪ হাজার পশু কম কোরবানি হয় ২০২০ সালে। এরপরের বছর ২০২১ সালে আরও সাড়ে ৩ লাখ কমে কোরবানি হয় প্রায় ৯১ লাখ পশু। অবশ্য ২০২২ সালে কিছুটা বেড়ে ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালের প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার পশু কম কোরবানি হয়েছে।

অবশ্য করোনা মহামারির আগে কোরবানির চিত্র ছিল উল্টো। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯—এই তিন বছরই ধারাবাহিকভাবে পশু কোরবানি বেড়েছিল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল হক তালুকদার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এবার কোরবানির পশুর দাম খুব একটা বাড়বে না। কেননা, দেশে চাহিদার চেয়ে এবার কোরবানিযোগ্য পশু বেশি রয়েছে। এক কোটি তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে। আর প্রস্তুতি রয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টির। চাহিদার চেয়ে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে।”

“তবে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে ক্রেতাদের। দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে পশুখাদ্যের উপকরণ ও সার্বিক লালন-পালনের খরচ। এর প্রভাব কোরবানির পশুর দামের উপরও পড়তে পারে।”

একই কথা বলেছেন, ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত যতটুকু খবর পাচ্ছি পশুর দাম খুব একটা বাড়বে না। গতবারের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি দামে বিক্রি হতে পারে। তবে আমরা শঙ্কিত দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। সবাই বলছে, মানুষের হাতে টাকা নেই। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো মানুষজন কোরবানি কম দেবে। চাহিদা কমে যাবে। সরবরাহ অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে কিন্তু দাম কমে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে।”

“এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ঢাকায় কেনাবেচা শুরু হলে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। তবে কোরবানির পশুর দাম অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। অতীতে দেখা গেছে, রাস্তায় যানজটের কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু বোঝাই ট্রাক ঢাকায় আসতে পারছে না। সরবরাহে ঘাটতি দেখা গেছে দাম বেড়ে গেছে। এ বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দেখতে হবে।”

“আর আরেকটি বিষয় আমি সবাইকে বলতে চাই। গুজবে কান দিয়ে গরু কিনবেন না। অতীতে দেখা গেছে, হাটে গরু নেই বলে একটি মহল গুজব ছাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করেছে। অথচ পরে দেখা গেছে, অনেক গরু বিক্রি না হয়ে ফিরে গেছে।”

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। আর কোরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ ২১ হাজার ৯৪১টি।

গতবার বড় গরু অবিক্রিত ছিল। বাজারে ছোট গরু পাওয়া যায়নি। এর একটাই মাত্র কারণ মানুষের হাতে টাকা ছিল না। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে আছে।

মানুষের আয় কমে গেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণাই বলছে, করোনা মহামারি ও যুদ্ধের কারণে দেশের দেড় কোটি নিম্নমধ্যবিত্ত নতুন করে গরিব বা দরিদ্র হয়েছে।

এতদিন ধনীদের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও কোরবানি দিতেন। নিম্নমধ্যবিত্তরা পাঁচ-সাত জন মিলে একটি গরু কিনে ভাগে কোরবানি দিতেন। কিন্তু যে নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব হয়েছেন, তাদের পক্ষে এবার কোরবানি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে ধারনা করা হচ্ছে।

আর সে কারণেই এবার পশু কোরবানি কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিডিএফএ সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।

প্রতিবারই উদ্বৃত্ত থাকছে

একসময় কোরবানির পশুর বড় উৎস ছিল ভারত। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটি থেকে গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এই সংকট কাটাতে সরকার দেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে সমৃদ্ধ করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশ এখন কোরবানির পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পশু উদ্বৃত্তও থাকছে। ফলে দেশের খামারিদের টিকিয়ে রাখতে পশু আমদানিতে অধিদপ্তর বিধিনিষেধও আরোপ করেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, দেশে কোরবানির পশু আগেও উদ্বৃত্ত থাকত। তবে ২০২০ সাল থেকে বেশি উদ্বৃত্ত থাকছে। ২০১৯ সালে যেখানে প্রায় পৌনে ১২ লাখ পশু উদ্বৃত্ত ছিল, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ লাখে। গত তিন ঈদে কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত ছিল ৭৪ লাখের বেশি।

দাম বাড়তে পারে

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর প্রতিবছর পশু কোরবানি বেড়েছে ৫ থেকে ১০ ভাগ হারে। বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়। তবে ২০২০ সাল থেকে পশু কোরবানি দেওয়া আগের বছরের তুলনায় কমে যায়। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশের অভ্যন্তরে নানা সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে বিপাকে পড়ে।

অন্যদিকে কোরবানির পশুর দামও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইটে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাজারদরের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১৭ জুন গরুর মাংসের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৬০০ টাকা। ২০২৩ সালের ১৭ জুন গরুর মাংস সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে ৭৮০ টাকায়। ২০২০ সালের একই দিনে খাসির মাংস সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় বিক্রি হলেও ২০২৩ সালের সেই দিনে তা বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ টাকায়।

কয়েক বছর ধরেই পশুর দাম বেশি। এবার পশুখাদ্যের দামও বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিলসহ নানা খাতেও বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। ফলে খামারিরা বলছেন, এবার পশুর দাম আরও বাড়তে পারে।

কোরবানি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম

বাংলাদেশ ক্যাটল ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আল মদিনা ক্যাটলের মালিক রমজান আলী মনে করেন এবারও কোরবানি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “কেউ কেউ পশু বেশি বিক্রি হচ্ছে দাবি করলেও আমার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। তা ছাড়া এবারও মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ। মাংসের দামও বাড়তি। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, কোরবানি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম।’

 

 

আমদানি করা পেঁয়াজের মান ভালো না, কিনছে না কেউ পরবর্তী

আমদানি করা পেঁয়াজের মান ভালো না, কিনছে না কেউ

কমেন্ট