সব চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রির ব্যবস্থা করলে দাম কমবে: ট্যারিফ কমিশন

সব চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রির ব্যবস্থা করলে দাম কমবে: ট্যারিফ কমিশন

প্যাকেটজাত চিনির দাম মোড়কে লেখা থাকে, তাতে দাম বাড়িয়ে রাখতে পারেন না বিক্রেতারা।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্র্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, রোববার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে।

বাস্তবে বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। রোববার রাজধানীর শেওড়াপড়া, হাতিরপুল ও মোহাম্মদপুর বাজারে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা দরে চিনি বিক্রি হতে দেখা গেছে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে ১৫০ টাকা কেজিতেও খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে। 

যদিও সরকার ১২০ টাকা দরে খোলা চিনি এবং ১২৫ টাকা দরে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির দর বেঁধে দিয়েছিল। 

সব দোকানে আবার চিনি পাওয়াও যাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে চাহিদামতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আর প্যাকেটজাত চিনি তো বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে কয়েক মাস আগে থেকেই। 

কোথাও এখন প্যাকেট করা চিনি বিক্রি হয় না; সব খোলা চিনি। এমনকি  স্বপ্ন, মিনা বাজারসহ বড় বড় শপিং মলগুলোও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করছে না। 

শেওড়াপাড়া বাজারের রায় স্টোরের বিক্রেতা রিপন বলেন, “১০ কেজি চিনি কারওয়ান বাজার থেকে নিয়ে এসেছি। খরচ বাদে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি না করলে লোকসান হবে।” 

চিনির বাজারের এই অস্থিরতার মধ্যে দামের লাগাম টেনে ধরতে বাজারে খোলা চিনি বিক্রি বন্ধ করে শতভাগ চিনি মোড়কজাত করে বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করলে দাম কমতে পারে সুপারিশ করেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন-বিটিটিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরে চিনির বাজারে অস্থিরতা কোনোভাবেই থামছে না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তার থেকে বাড়তি দামে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে। চিনির দামে লাগাম না থাকার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকটসহ নানা কারণ উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। 

সরকারি সংস্থাটি বলছে, দেশে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৪ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি ও ৫০ হাজার টন পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়ে থাকে। অপরিশোধিত চিনি পরিশোধনের পর বাজারে আসে। বিক্রি হয় ৫০ কেজির বস্তায় ও এক কেজির প্যাকেটে। 

প্যাকেটজাত চিনির দাম মোড়কে লেখা থাকে, তাতে সহজে দাম বাড়িয়ে রাখতে পারেন না বিক্রেতারা। তবে ৫০ কেজির বস্তায় ভরে যে খোলা চিনি বাজারে ছাড়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে দোকানিরা এক কেজির প্যাকেট করে খুচরায় বিক্রি করেন। সে ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম রাখেন, যা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে।

এদিকে দাম নিয়ে সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হলে কোম্পানিগুলো বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দেয়। তখন বাজারে কিছু খোলা চিনি ছাড়লেও প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ একেবারে কমিয়ে ফেলে তারা। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাজারে ৯৫ শতাংশ চিনিই খোলা বিক্রি হয়। বাকি ৫ শতাংশ চিনি প্যাকেটজাত করে ছাড়ে কোম্পানিগুলো। এই ৫ শতাংশ চিনির প্যাকেটের গায়ে দাম উল্লেখ করে দেওয়ার কারণে কোম্পানি থেকে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে রাখতে গেলে ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বিক্রেতারা। 

বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানিয়েছে, বাজারে চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এক কেজির পাশাপাশি আধা কেজি, দুই ও পাঁচ কেজির প্যাকেটজাত চিনি বাজারে আনা যেতে পারে। 

আর ৫০ কেজির চিনির বস্তা শুধু করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হবে। তাতে খুচরা বাজারে বস্তার চিনি ভেঙে কেজি দরে বাড়তি দামে বিক্রি করার সুযোগ থাকবে না। সরকারিভাবে চিনির যে দাম বেঁধে দেওয়া হবে, তা কার্যকর হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে। 

বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, “এই মুহূর্তে বাজারের যে অবস্থা, তাতে নতুন করে প্যাকেটজাত চিনি নিয়ে আসতে গেলে খরচ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, মোড়কজাত করতে আলাদা খরচ আছে। তাতে অস্থিরতা কমানোর যে উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর না-ও হতে পারে।”

 

বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠিতে আরও জানায়, দেশে শতভাগ চিনি মোড়কজাত করে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই পাইকারি ও খুচরা বাজারে লটে চিনি বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের সেকেন্ডারি মার্কেট সরকার ও মিলমালিকদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। 

এ জন্য নিত্যপণ্যের সেকেন্ডারি বাজার নিয়ন্ত্রণে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থায় সেকেন্ডারি ক্রেতারা নিবন্ধিত হয়ে পণ্য কেনাবেচা করলে সরকারিভাবে বাজারে তদারকি বাড়ানো সম্ভব হবে। 

সম্প্রতি চিনির বাজারের অস্থিরতা নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের তৈরি প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে চিনির সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির মতে, পরিশোধন মিল থেকে চিনি সরবরাহে বিশৃঙ্খলার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বাজারে চিনির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

চিনির বাজারে অস্থিরতা থামাতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “ট্যারিফ কমিশন সরকারের হয়ে বাজার-সংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন পাঠায়। তারা চিনির বাজার নিয়ে এমন কোনো সুপারিশ করে থাকলে তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” 

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) রোবারের বাজারদরের তালিকা বলছে, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও ক্রেতারা ১৪০ টাকার নিচে চিনি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। দাম কোথাও কোথাও ১৫০ টাকাও রাখা হচ্ছে। 

স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় চিনি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হলেও স্থানীয় চিনির উৎপাদন মাত্র ১ শতাংশ। চিনি আমদানি হয় বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত চিনির পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার টনের মতো; অর্থাৎ চিনির বাজার প্রায় পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। 

আবার অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান-সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম। 

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বাড়তি দামে কয়েক মাস ধরেই চিনি বিক্রি হয়ে আসছে বাজারে। কিন্তু মিলমালিকেরা চান দাম আরও বাড়াতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তি। এ জন্য দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করতে চান তারা। 

সব ধরনের খরচ ও মুনাফাসহ সরকার চিনির যে দামের হিসাব দিচ্ছিল, তা কিছুতেই মানছিলেন না মিলমালিকেরা। 

এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদের আগে ১৯ জুন হঠাৎ করেই চিনিকলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন ঘোষণা দেয় ২২ জুন বৃহস্পতিবার থেকে তারা প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১৫০ টাকা ও খোলা চিনি ১৪০ টাকা দরে বিক্রি করবে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) নতুন এ দরের কথা জানিয়ে ওই দিন চিঠিও দেয় চিনিকলমালিকদের সংগঠনটি। একই চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও দেওয়া হয়। 

ওই চিঠির পর ২১ জুন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে বিটিটিসি। বিটিটিসির চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম এতে সভাপতিত্ব করেন। 

ওই বৈঠকে চিনির দাম ঈদের আগে না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ঈদের পরে বিটিটিসির সঙ্গে এ নিয়ে মিলমালিকদের আবার বৈঠক হবে। তখন আন্তর্জাতিক বাজার ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হবে বলে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। 

পরের দিন ২২ জুন মিলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। 

ওই বৈঠকের পর বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে। অন্যদিকে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে। চিনি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। সে বিষয়ে ট্যারিফ কমিশন একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনও তৈরি করেছে। 

“তবে এখনই চিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের জন্য কোনো বৈঠক করা সম্ভব হচ্ছে না। কোরবানির ঈদের পরে তাদের সঙ্গে আবার বৈঠক হবে। তার আগে কোনো অবস্থাতেই দাম বাড়ানো যাবে না।” 

“চিনির দাম বিষয়ে অ্যাসেসমেন্ট আছে। সে অনুযায়ী ভোক্তা অধিকারকে বাজারে মনিটরিং করতে হবে। অ্যাট লিস্ট ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের চেয়ে যাতে কোম্পানিগুলো বেশি দাম না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।” 

বেড়েছে সবজি ও মাছের দাম, কাঁচা মরিচ উঠছে-নামছে পরবর্তী

বেড়েছে সবজি ও মাছের দাম, কাঁচা মরিচ উঠছে-নামছে

কমেন্ট