বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ফের বাড়ছে
বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরব ও রাশিয়া সরবরাহ কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই চড়ছে তেলের বাজার।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ফের বাড়ছে। বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরব ও রাশিয়া সরবরাহ কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই চড়ছে তেলের বাজার।
বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১টায় ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচারের দাম প্রায় ১ ডলার বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার ৩৭ সেন্টে ওঠে। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। মে মাসের পর ব্রেন্ট ক্রুডের দর ৮০ ডলার ছাড়াল।
সেই সঙ্গে ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড ১ ডলারের বেশি বেড়ে পৌঁছেছে ৭৬ ডলারে। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
আগের ক্ষতি পোষানোর জন্য সৌদি আরব ও রাশিয়া সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করায় দাম বাড়ছে। ডলারের বিনিময় হার হ্রাসের প্রভাবও জ্বালানির দামে পড়েছে। খবর রয়টার্সের।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব ও রাশিয়া সরবরাহ কমাবে—এ খবরে তেলের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে ডলারে বিনিময় হার হ্রাস সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ডলারের বিনিময় হার কমার কারণে আমদানিকারক দেশগুলোয় তেলের চাহিদা বেড়ে যায়।
বিশ্লেষক এডওয়ার্ড ময়া রয়টার্সকে বলেন, “বর্তমানে তেলের বাজারে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এই স্থিতিশীলতা বিনষ্টের একটিই কারণ আছে, সেটা হলো- যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে যদি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আবারও নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে দেশটিকে মন্দার দিকে নিয়ে যায়, তাহলেই কেবল তা হতে পারে।”
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে ফেডারেল রিজার্ভ আবারও নীতি সুদহার বাড়াতে পারে; তা সত্ত্বেও অনেক কর্মকর্তা এত দিন যেভাবে বলেছেন অর্থাৎ নীতি সুদহার বৃদ্ধির চক্র শেষ হয়ে আসছে, সেই কথা থেকে বাজার কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল।
এ ছাড়া চীন প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া দিতে আরও অনেক ব্যবস্থা নেবে—এমন আশাও করছেন অনেকে। অর্থাৎ চীনের জ্বালানি চাহিদা বাড়লে তেলের দাম আরও বাড়বে। এই সপ্তাহে বাজারে তেলের চাহিদা পরিমাপ করার জন্য ইউএস কনজ্যুমার প্রাইজ ইনডেক্সের তথ্য ও চীনের অর্থনৈতিক প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে আছেন বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে সৌদি আরব গত সপ্তাহে বলেছে, দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের যে সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে, তা অন্তত আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া হবে।
এ ছাড়া রাশিয়া আগামী মাস থেকে দিনে পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দেয়।
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
গত ৫ বছরের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।
সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
২০২১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দর ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এর পর থেকে অবশ্য তেলের দাম নিম্মমূখীই ছিল। কমতে কমতে গত জুন মাসে দুই ধরনের তেলের ব্যারেলই ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে।
২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এরপর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে-তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
কমেন্ট