শস্যচুক্তি স্থগিত করল রাশিয়া
কৃষ্ণসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিমিয়ান সেতুতে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শস্যচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির জন্য এই চুক্তি করা হয়।
রাশিয়াকে অধিভুক্ত অঞ্চল ক্রিমিয়ার সাথে সংযুক্তকারী ১৯ কিলোমিটার সড়ক ও রেল সেতুতে সোমবার ভোরের কিছুক্ষণ আগে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক দম্পতি নিহত ও তাদের মেয়ে আহত হয়।
ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সেনাদের যাতায়াতের জন্য অন্যতম প্রধান সড়ক এটি। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত আগ্রহের প্রকল্প ছিল এই সেতু। বিস্ফোরণকে সন্ত্রাসী হামলা বলে মন্তব্য করেছে রাশিয়া। খবর রয়টার্সের
ক্রেমলিন জানিয়েছে, শস্যচুক্তি স্থগিতের সাথে সেতুতে হামলার কোন সম্পর্ক নেই। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, সোমবার থেকেই শস্যচুক্তি স্থগিত কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, এই চুক্তিতে থাকা রাশিয়া সম্পর্কিত অংশগুলো এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।”
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, মস্কো এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিরুদ্ধে। এই সিদ্ধান্তটি তুরস্ক, ইউক্রেন এবং জাতিসংঘকে অবহিত করা হয়েছে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন হল বিশ্বের দুই শীর্ষ কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী দেশ। গম, বার্লি, ভুট্টা, রেপসিড, রেপসিড তেল, সূর্যমুখী বীজ এবং সূর্যমুখী তেলের প্রধান রপ্তানিকারক তারা। এ ছাড়া সারের বাজারেও রাশিয়ার আধিপত্য আছে।
শস্যচুক্তি
গত সপ্তাহে পুতিন জানান, রাশিয়ার সাথে সম্পর্কিত চুক্তির অংশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই তিনি এতে রুশ অংশগ্রহণ স্থগিত করার কথা ভাবছেন এবং শর্ত পূরণ হলে রাশিয়া চুক্তিতে ফিরে আসবে।
রাশিয়াকে কৃষ্ণ সাগর চুক্তিতে সম্মত করতে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে একটি তিন বছরের চুক্তি হয়েছিল। যার অধীনে জাতিসংঘ রাশিয়াকে তার খাদ্য এবং সার বিদেশি বাজারে রপ্তানি করতে সহায়তা করতে সম্মত হয়।
যদিও রাশিয়ার খাদ্য ও সারের উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে মস্কো বলছে, অর্থপ্রদান, সরবরাহ এবং বীমার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রপ্তানিতে সমস্যা হচ্ছে।
রাশিয়া গত বছরে তিনবার কৃষ্ণ সাগর চুক্তি বাড়ানোর জন্য সম্মত হয়। তবে অক্টোবরে ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবহরে ড্রোন হামলার প্রতিক্রিয়ায় কিছু সময়ের জন্য চুক্তি স্থগিত রাখে।
গত সপ্তাহে পুতিন বলেন, চুুক্তি থেকে আমরা সরে আসতে পারি। যদি সবাই আবারো বলে যে, আমাদেরকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা করা হবে। তাহলে সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করুক। আমরা অবিলম্বে চু্ক্তিতে ফিরব।
রাশিয়া অভিযোগ তোলে যে, দরিদ্র দেশগুলোতে পর্যাপ্ত শস্য পৌঁছেনি। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বক্তব্য হলো, চু্ক্তির মাধ্যমে শস্য রপ্তানিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। এতে (দরিদ্র) দেশগুলো উপকৃত হয়েছে।
শস্যচুক্তি নবায়নে ঢাকার উদ্যোগ চান ব্যবসায়ী নেতারা
গত ১১ জুলাই বাংলাদেশের ছয়টি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে জোরালোভাবে চেষ্টা চালাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছে।
ওই বিবৃতিতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলেছে, বিএসজিআই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন। এই চুক্তি নবায়ন না হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে ঝুঁকির মুখোমুখি হবে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এই সংগঠনগুলো।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এবং ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয়।
আইসিসি বাংলাদেশ অফিস থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, বিএসজিআই এখন পর্যন্ত তিনটি ইউক্রেনীয় বন্দর থেকে তিনটি মহাদেশের ৪৫টি দেশে ৩ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যসামগ্রী রপ্তানির সুযোগ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে রপ্তানি করা গমের পরিমাণ যুদ্ধের আগের তুলনায় অনেকাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই চুক্তির প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে রাশিয়া থেকে খাদ্য ও সার রপ্তানির বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ২২ শতাংশ কমেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিএসজিআই ব্যবস্থার আওতায় ইউক্রেন থেকে ২০২১ সালের মতো একই পরিমাণ, অর্থাৎ সাত লাখ টন গম কিনেছে। এই শস্য আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে তাদের মানবিক কার্যক্রমে সহায়তা করছে।
ছয় সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, ইউক্রেন ও রাশিয়ার খাদ্য ও সার রপ্তানির অব্যাহত সুবিধা সে কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই চুক্তি নবায়ন না হলে তা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং ক্রয়ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন করবে।
“এটা হবে এমন এক পরিস্থিতি যার সত্যিকার অর্থে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সবার ওপরে একটি মানবিক পরিণতি থাকবে।”
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর দেশটি থেকে শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিভিন্ন দেশে খাদ্যসংকট তৈরির শঙ্কা দেখা দিলে গত বছরের ২২ জুলাই জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের তিনটি বন্দর দিয়ে নিরাপদে শস্য রপ্তানিতে দুই দেশের মধ্যে বিএসজিআই চুক্তি হয়।
চুক্তির পর গত বছরের ১ আগস্ট ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়। এর আগে কয়েক দফায় এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
জানা যায়, কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়া। চুক্তি নবায়ন না হওয়ার অর্থ ইউক্রেনের বন্দর থেকে কোনো শস্যবাহী জাহাজ বিশ্বের কোনো দেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে না রাশিয়া। আবার চুক্তি শেষ হয়ে গেলে ঝুঁকি নিয়ে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজও ইউক্রেন থেকে পণ্য পরিবহনে রাজি হবে না। কৃষ্ণসাগর এড়িয়ে সাগরপথে বিকল্প কোনো রুট নেই ইউক্রেনের।
কমেন্ট