বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে: বিশ্ব ব্যাংক
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলোটপালট হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। পাল্টে গেছে সব হিসাবনিকাশ। ছোট-বড় সব দেশের অর্থনীতিতেই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকায় বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচকের লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ব্রাজিলসহ ছোট-বড় সব দেশে ঋণের সুদের বাড়িয়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা কমানো হয়।
পণ্যের দাম কমাতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশ খানিকটা কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন দেখা যায়, বাংলাদেশ, মিসর, পাকিস্তান, জাপান, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, মালদ্বীপে এ হার কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া সব দেশেই খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমছে। বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেশি এমন সব দেশেও এ হার কমতে শুরু করেছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমা-বাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের কারণ জড়িত। তবে বাংলাদেশে মূলত পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাবে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার কমছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আশার কথা হচ্ছে, গত কয়েক মৌসুম আমাদের বোরো-আমনের ভালো ফলন হয়েছে। সে কারণেই আমরা বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। গত এক-দেড় বছর চাল আমদানি করতে হয়নি। একবার ভেবে দেখুন, ডলার সংকটের এই সময়ে যদি চাল আমদানি করতে হতো, তাহলে অবস্থা কেমন হতো। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত?”
বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে এমন সব দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমায় আগামীতে এ দেশেও কমবে। কারণ এখনো বাংলাদেশ বিদেশ থেকে বেশি দামে পণ্য আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উঠেছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ৮ দশমিক ১ শতাংশে নামে। মার্চে তা আবার বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হয়। এপ্রিলে তা আবার কমে ৮ দশমিক ৮ শতাংশে নামে। মে মাসে আবার বেড়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশে ওঠে। জুনে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। দেশটিতে গত সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৪ শতাংশে উঠেছিল। এর পর থেকে তা কমছে। গত মে পর্যন্ত কমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ভুটানেও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। গত বছরের জুলাইয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। গত মার্চে তা কমে দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছিল। এখন তা সামান্য বেড়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।
নেপালে গত সেপ্টেম্বরে এ হার সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ শতাংশ ওঠে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে সামান্য বেড়ে মার্চে আবার কমেছে। এপ্রিলে বেড়ে মে মাসে আবার কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। গত মে পর্যন্ত তা বেড়ে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশে উঠেছে। জুনে সামান্য কমে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে।
মালদ্বীপে গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। মার্চে তা আরও বেড়ে ৮ শতাংশে ওঠে। এর পর থেকে কমে এখন ৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে।
তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলা শ্রীলঙ্কায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগস্টে সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে জুনে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমার কারণে এ হার কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চীনে গত সেপ্টেম্বরে এ হার সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৮ শতাংশে ওঠে। এর পর থেকে তা সামান্য হারে ওঠানামা করেছে। গত মে মাসে ১ দশমিক ১ শতাংশে নামে। জুনে সামান্য বেড়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় গত নভেম্বরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৪ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে নেমেছে। ইন্দোনেশিয়ায় গত বছরের জুলাইয়ে ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জানুয়ারি পর্যন্ত তা কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে মার্চ থেকে আবার কমতে শুরু করেছে। জুনে তা কমে এখন ১ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
থাইল্যান্ডে গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এখন তা কমে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। ফিলিপাইনে গত জানুয়ারিতে বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ২ শতাংশে উঠেছিল। ফেব্রুয়ারি থেকে তা কমতে থাকে। গত জুনে কমে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে।
ব্রাজিলে গত বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এর পর থেকে কমে গত জুনে ৪ শতাংশে নেমেছে। গত জুলাইয়ে আর্জেন্টিনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১১৭ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির মুদ্রার মান ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় তাদের মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এর প্রভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও বাড়ছে।
তুরস্কে গত নভেম্বরে সর্বোচ্চ ১০২ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। মিসরে এ হার বেড়ে যাচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ভিয়েতনামে গত জুলাইয়ে ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জাপানে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। দেশটিতে এ হার বাড়ার কারণ হচ্ছে তারা নিজেদের মুদ্রা ইয়েনকে প্রতিযোগিতায় ধরে রাখতে বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে।
রাশিয়াতে গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত এপ্রিলে তা শূন্যে নেমে আসে। মে মাসে নেতিবাচক পর্যায়ে নেমে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। গত মার্চে তা ১৪ দশমিক ৫ শতাংশে ওঠে। এখন ১২ শতাংশে নেমেছে।
ফ্রান্সে গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। পরে তা বেড়ে মার্চে ১৭ দশমিক ২ শতাংশে ওঠে। পরে তা কমে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। জার্মানিতে গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে ১৭ দশমিক ২ শতাংশে ওঠে। এখন তা কমে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে।
ইটালিতে জুলাইয়ে ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। অক্টোবরে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে ওঠে। এখন তা কমে ১১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। কোরিয়াতে জুলাইয়ে ৮ দশমিক ১ শতাংশে ওঠে। পরে তা কমতে থাকে। এখন ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে।
কুয়েতে জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ শতাংশে ওঠে। এখন তা কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। সৌদি আরবে জুলাইয়ে ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অক্টোবরে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৬ শতাংশে ওঠে। এখন তা কমে দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। সিঙ্গাপুরে জুলাইয়ে ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। পরে তা বেড়ে জানুয়ারিতে ৮ দশমিক ১ শতাংশে ওঠে। এখন তা কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে।
যুক্তরাজ্যে জুলাইয়ে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। পরে তা মার্চে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশে ওঠে। এর পর থেকে কমে এখন ১৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগস্টে ১১ দশমিক ৪ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে ৬.৭ শতাংশে নেমেছে।
কমেন্ট