এবার যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান কমাল ফিচ রেটিংস, ক্ষুব্ধ হোয়াইট হাউস
ফিচ, মুডিস ও এসঅ্যান্ডপির মতো আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলো প্রায়ই উন্নয়নশীল দেশের ঋণমান হ্রাস-বৃদ্ধি করে। তবে এবারে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান হ্রাস করেছে ফিচ রেটিংস। আর এই ঘটনায় হোয়াইট হাউস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীরাও বিস্মিত হয়েছেন।
এবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান কমিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংস।
ফিচ, মুডিস ও এসঅ্যান্ডপির মতো আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলো প্রায়ই উন্নয়নশীল দেশের ঋণমান হ্রাস-বৃদ্ধি করে। তবে এবারে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান হ্রাস করেছে ফিচ রেটিংস। আর এই ঘটনায় হোয়াইট হাউস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীরাও বিস্মিত হয়েছেন।
গত ২৬ জুলাই বাংলাদেশবিষয়ক ঋণমান আভাস বা রেটিং আউটলুক কমিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এত দিন ছিল স্থিতিশীল, কিন্তু এখন তারা তা কমিয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘নেতিবাচক’ ঋণমান নির্ধারণ করেছে।
এর আগে চলতি বছরের ৩১ মে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর কথা ঘোষণা দেয়।
ঋণমান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে তিন প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে ‘বিগ-থ্রি’ বলা হয়। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের ঋণমান কমার কথা বলেছে। তবে ফিচ রেটিংস চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু প্রকাশ করেনি।
ফিচের যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান কমানোর বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, ফিচ রেটিংস যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান ‘এএএ’ থেকে হ্রাস করে ‘এএপ্লাস’ করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছে, তাদের ধারণা, আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হবে। সেই সঙ্গে মাসখানেক আগে জাতীয় ঋণের সীমা বৃদ্ধির আলোচনা যেভাবে শেষ মুহূর্তে গড়াল, তা দেশটির জন্য ভালো হয়নি।
বিশ্বের তিনটি বড় ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম এই ফিচ রেটিংস গত মে মাসেই এমন আভাস দিয়েছিল। তবে ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে জটিলতার অবসান হলে জুন মাসে তারা আগের অবস্থানই ধরে রাখে। যদিও তখনই তারা বলেছিল, বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান চূড়ান্ত করা হবে।
স্বাভাবিকভাবেই ফিচের এই ঘোষণার পর বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দর কমেছে। স্টক ফিউচার্স সূচক কমেছে, যদিও ট্রেজারি ফিউচার্স সূচক বেড়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এর প্রভাব তেমন একটা গুরুতর হবে না।
এর আগে ২০১১ সালে এসঅ্যান্ডপি একইভাবে ঋণের সীমা নিয়ে ঐকমত্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান হ্রাস করে ‘এএ প্লাস’ করেছিল। এখনো তারা সেটা ধরে রেখেছে। সেবার যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টক মার্কেটে শেয়ারের দরপতন হয়। তখন ইউরো অঞ্চলেও আর্থিক সংকট চলছিল। এবার তেমন কিছু নেই। তাই এবার বড় ধরনের সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিবৃতিতে ফিচ রেটিংস বলেছে, “গত ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন ব্যবস্থার মান কমেছে। রাজস্ব ও ঋণের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব দেখা গেছে, যদিও জুন মাসে দেশটির সরকার ও বিরোধী দল ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ঋণের বর্তমান সীমা স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন ফিচ রেটিংয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ফিচের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং পুরোনো তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তা করা হয়েছে।
হোয়াইট হাউসও একই কথা বলেছে। তারা ফিচের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারিন জঁ পিয়েরে বলেছেন, “ফিচের এই প্রতিবেদনে বাস্তবতা অস্বীকার করা হয়েছে। এমন এক সময়ে এই অবনমন তারা করল, যখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।”
ভাবমূর্তির ক্ষতি
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফিচের এই ঋণমান অবনমনের সিদ্ধান্ত বোঝা যায়, জাতীয় ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তার জেরে দেশটির ভাবমূর্তি কতটা বিনষ্ট হয়েছে। একদম শেষ মুহূর্তে এই ঋণসীমা স্থগিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তা না হলে দেশটি ঋণখেলাপি হয়ে যেত, যদিও তারা ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ঋণখেলাপি হয়নি।
মিঝুহো সিকিউরিটিস ইউএসএর প্রধান অর্থনীতিবিদ স্টিভেন রিচুইতো রয়টার্সকে বলেন, “এই ঘটনায় বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যয় সমস্যাজনক।”
ফিচ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ঋণসীমা স্থগিতের বিষয়ে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হওয়ার কারণে দেশটির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মানুষের আত্মবিশ্বাস বিনষ্ট হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অবস্থান বজায় থাকবে, কিন্তু দেশটির ভাবমূর্তিতে কালো দাগ পড়েছে।
অনেক বিশ্লেষক আবার এই সময়ে ঋণমান অবনমনের ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দ্য হ্যামিল্টন প্রজেক্টের পরিচালক ওয়েন্ডি এডেলবার্গ বলেছেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এখন তারা নেতিবাচক তথ্য পেল কোথায়। ঋণসীমা স্থগিতের সিদ্ধান্তের আগে তারা তেমন তথ্য পেলে ঠিক ছিল, কিন্তু এখন কীভাবে পেল তারা।’
এসব সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ফিচের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব তেমন একটা গুরুতর হবে না। অ্যালবিয়ন ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা জেসন অয়্যার রয়টার্সকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না, ফিচ ঋণমান কমানোর কারণে বিনিয়োগকারীরা দলে দলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, বিশেষ করে যাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে।’
অন্যদিকে ফিচ আরও আশঙ্কা করছে, বছরের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্র মৃদু মন্দার কবলে পড়তে পারে।
যদিও নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান মনে করছেন, গত এক বছরে অর্থনীতির জগতের সবচেয়ে বড় খবর হলো, মন্দার কবলে না পড়েও যুক্তরাষ্ট্র মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে।
কমেন্ট