বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বেড়েছে
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, সরবরাহ কমে যাওয়ায় তেলের দাম বাড়ছে। গত ছয় সপ্তাহে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বেড়েছে।
অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্যানুসারে, শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১ ডলার ১০ সেন্ট বা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৮৬ ডলার ২২ সেন্ট। আর ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ১ ডলার ৩০ সেন্ট বেড়ে উঠেছে ৮২ ডলার ৮২ সেন্টে; শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, সরবরাহ কমে যাওয়ায় তেলের দাম বাড়ছে। গত ছয় সপ্তাহে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
মূলত ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো সরবরাহ হ্রাস করার কারণে তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেলের চাহিদা বৃদ্ধির কারণেও দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
চলতি বছর ব্রেন্ট ক্রুডের সর্বোচ্চ দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৮ ডলার ৩১ সেন্ট, গত ৮ মার্চ তেলের দাম এই পর্যায়ে উঠেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ব্যাংকের বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা এ রকম, “আমাদের মতে, তেলের দাম ২০২৩ সালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠতে যাচ্ছে। এই সপ্তাহে ওপেকের বৈঠকে সৌদি আরব তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত আরও এক মাসের জন্য বাড়াতে পারে, সে কারণেই আমাদের মনে হচ্ছে, তেলের দাম বছরের চূড়ায় উঠতে যাচ্ছে।”
তেলের দাম বাড়াতে ওপেক কয়েক মাস ধরেই তেল উৎপাদন কমাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী সৌদি আরব, ওপেকের সিদ্ধান্তের বাইরেও তারা দিনে ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ ব্যারেল তেল কম উত্তোলন করছে। আগস্ট পর্যন্ত তাদের তেলের উৎপাদন হ্রাস করার কথা ছিল।
তবে শুক্রবার অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তারা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তের মেয়াদ আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে চায়-সে আভাস আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে কারণেই তেলের বাজার চড়েছে।
তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠকের কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
চলতি বছরের জুনে ওপেক, রাশিয়াসহ সহযোগী দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত তেলের উৎপাদন হ্রাস করা হবে। তখন সৌদি আরব গত জুলাই পর্যন্ত নিজে থেকেই আরও ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ৩ জুলাইয়ের বৈঠকে তারা এটি আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে সৌদি আরব কথামতো উৎপাদন কমাতে পারেনি। জুলাইয়ে তারা ১০ লাখের পরিবর্তে ৮ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত উৎপাদন কমিয়েছে। ওপেকের সামগ্রিক উৎপাদন ৮ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত কমেছে। গত সোমবার রয়টার্সের এক জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মে মাসে দেশটির তেলের চাহিদা দৈনিক ২ কোটি ৭ লাখ ব্যারেলে ওঠে, ২০১৯ সালের আগস্টের পর যা সর্বোচ্চ। এ ছাড়া দেশটিতে গ্যাসোলিনের চাহিদাও বেড়েছে। মে মাসে এই চাহিদা দৈনিক ৯১ লাখ ১০ হাজার ব্যারেলে ওঠে, ২০২২ সালের জুনের পর যা সর্বোচ্চ।
গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল ও গ্যাসোলিনের মজুত কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রয়টার্সের এক জরিপে দেখা গেছে, ২৮ জুলাই শেষ হওয়া সপ্তাহে মজুত প্রায় ৯ লাখ ব্যারেল কমেছে।
বাংলাদেশর বাজার
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে।
এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।
সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
২০২১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দর ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল।
মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এর পর থেকে অবশ্য তেলের দাম নিম্মমূখীই ছিল। কমতে কমতে গত জুন মাসে দুই ধরনের তেলের ব্যারেলই ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে।
২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এরপর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে-তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার।
অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
কমেন্ট