ডিমের ডজন ১৭০, একটা ১৫ টাকা

ডিমের ডজন ১৭০, একটা ১৫ টাকা

বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে প্রতি হালি ডিম ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; একটা ডিমের দাম পড়ছে ১৫ টাকা।

আমিষের সহজলভ্য উৎস ডিমের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুঁটছে। প্রতিদিনই ডজনে পাঁচ টাকা করে বাড়ছে। 

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, ছুটির দিন শুক্রবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিম ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিটি ডিমের দাম ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা; ডজন ১৬৫ টাকা।

তবে বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে প্রতি হালি ডিম ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; একটা ডিমের দাম পড়ছে ১৫ টাকা। 

গত বছরের আগস্টে এই ডিমের দাম বাড়তে বাড়তে প্রতি ডজন ১৬০ টাকায় উঠেছিল। সে সময় দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বেড়েছে বলে অজুহাত দেখিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।  

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে দেশে ডিমের দাম কমে ১২০-১২৫ টাকা ডজনে নেমে এসেছিল। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে ডিমের দাম বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। 

এ ছাড়া দেশি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা ডজন দরে। হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়।

 

শুধু ডিম নয়, সব ধরনের মুরগির দামও বেড়েই চলেছে।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারের ডিম বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আজ প্রতি ডজন লাল ফার্মের ডিম ১৭০ টাকায় বিক্রি করছি। গতকাল বিক্রি করেছি ১৬৫ টাকায়। আগের দিন ছিল ১৬০ টাকা। প্রতিদিন ডজনে ৫ টাকা করে বাড়ছে।” 

কেনো ডিমের দাম বাড়ছে-এ প্রশ্নের উত্তরে দেলোয়ার বলেন, “বৃষ্টির কারণে বাজারে ডিম কম আসছে, তাই দাম বাড়ছে।” 

এই দোকানে ডিম কিনতে এসেছিলেন বেসরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তা এস এম মনিরুজ্জামান। এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “১৭০ টাকা এক ডজন ডিম কিনলাম। গত সপ্তাহে কিনেছিলাম ১৬০ টাকায়। সব জিনিসের দামই বেশি। বাজার করতে আসলেই বাড়তি খরচ হচ্ছে। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।” 

মুরগির দামও চড়ছে

শুক্রবার শেওড়াপাড়া, হাতিরপুর ও মেহাম্মদপুর কাঁচাবাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে গত এক সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে মুরগির দাম। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা কেজি। এই সপ্তাহে দরদাম করে সেই ব্রয়লার মুরগি কিনতে হচ্ছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকায়।

ব্রয়লারের সঙ্গে বেড়েছে সোনালি মুরগির দামও। গত সপ্তাহে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা কেজির সোনালি মুরগি এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩১০ টাকায়। আর দেশি মুরগি কেজি ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

শেওড়াপাড়া বাজারের মুরগি বিক্রেতা কাওসার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কোরবানির ঈদে চাহিদা কম থাকায় মুরগির বাজার নেমে এসেছিল। দুই সপ্তাহ ধরে বাজারটা আবার বাড়তি। চাহিদাও বেড়েছে। তবে বাজারে মুরগির সরবরাহে বড় কোনো সংকট নেই।” 

ডিমের দাম কেন বাড়ছে 

করপোরেট সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের দাম আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। 

বিপিএ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন আশঙ্কার কথা জানায়। এতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার। 

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ কারণে সরবরাহ–ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর এ খাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে তাদের আধিপত্য বেড়েছে, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ। 

সুমন হাওলাদার বলেন, ছোট খামারি ও ডিলাররা পোলট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটালেও আজ তারা অসহায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৫০ লাখ প্রান্তিক উদ্যোক্তার অধিকাংশই ব্ল্যাঙ্ক চেকের মাধ্যমে জিম্মি হয়ে পড়েছেন কোম্পানির দাদন ব্যবসার কাছে। বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৮৭ পয়সা থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত। ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের বাধ্য হয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা কমে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় মুরগি বিক্রয় করতে হচ্ছে। 

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, উৎপাদন খরচ যাচাই করে পোলট্রি ফিডের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত সরকারের। ২০২১ সালে ১ কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৮ টাকা, ৫০ কেজির ১ বস্তা পোলট্রি খাবারের দাম ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। ২০২২ সালের শুরুতে ভুট্টার দাম ছিল ২৮ টাকা, আর ৫০ কেজির ১ বস্তা খাবারের দাম ছিল ২ হাজার ৭০০ টাকা। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দোহাই দিয়ে লাগামহীনভাবে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টার দাম হয় ৪১ টাকা কেজি। আর পোলট্রি খাবারের ৫০ কেজি বস্তার দাম পৌঁছায় ৩ হাজার ৭৪০ টাকায়।

 

চলতি বছরের মার্চ মাসে ভুট্টার দাম কমে দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৬ টাকা কেজি। অথচ পোলট্রি খাবারের দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা বাড়ানোর পরে কমানো হয়েছে মাত্র ৩ টাকা। খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে ডিম ও মুরগির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বিপিএ। 

মাঠে নামছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

ডিমের দামের এই উল্লম্ফন অস্বাভাবিক ঠেকছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে। 

ডিমের দামের এই রেকর্ডের পেছনে কারসাজি রয়েছে কি না, তা খোঁজে অভিযানে নামছেন বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। 

ডিম বিক্রেতারা সরবরাহ কমে যাওয়াকে কারণ দেখিয়েছেন। খামারিরা উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ দেখাচ্ছেন গত কিছু দিনের অতিরিক্ত গরমের পর এখনকার অতিবৃষ্টিকে। 

এই অবস্থায় ডিম সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে রোববার সভা ডাকা হয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। 

বর্ষায় খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে প্রতি বছর এই সময় ডিমের দাম কিছুটা বাড়ে। তবে এবার দাম বৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। 

ডিমের দাম এত বেশি আগে কখনও না দেখার কথা জানিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “প্রান্তিক মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।” 

কারসাজি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে কি না, তা বের করতে অভিযানে নামছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আজকে রাতের মধ্যেই প্রয়োজনীয় জায়গায় অভিযান চালানো হতে পারে।” 

ডিমের দাম এত বাড়ার পেছনে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এমদাদুল হক তালুকদার। 

তিনি বলেন, “আমাদের হিসাব অনুযায়ী একটা ডিমের উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১০ টাকা। আমাদের জানা মতে, ডিমের যে দাম বাড়ছে, তা আসলে মধ্যস্বত্বভোগীরাই হাতিয়ে নিচ্ছে।” 

পরিস্থিতি বুঝতে রোববার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। 

এমদাদুল হক বলেন, “রোববার প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ডিম উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজারজাতকারীসহ সকল পক্ষ নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে এই দাম বৃদ্ধির জন্য কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” 

খোলা সয়াবিন বিক্রির সময় আরও ৬ মাস বাড়ল পরবর্তী

খোলা সয়াবিন বিক্রির সময় আরও ৬ মাস বাড়ল

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর