পেঁয়াজের বাজার ফের অস্থির, ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই
ডিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই চড়ছে মসলা জাতীয় এই পণ্যের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা, কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে।
পেঁয়াজের দর আবার পাগলা ঘোড়ার মতো ছুঁটছে। ডিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই চড়ছে মসলা জাতীয় এই পণ্যের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা, কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, শনিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়।
এক সপ্তাহ আগে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়; আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।
তবে রাজধানীর বাজারগুলোতে শনিবার প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।
শেওড়াপড়া বাজারের মুদি দোকান রায় ট্রেডার্সের মালিক রিপন রায় এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আজ (শনিবার) দেশি পেয়াজ ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৬০ টাকায়।”
ঢাকার কারওয়ান বাজার, হাতিরপুর ও মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজরেও একই দরে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তবে পাড়া-মহল্লার দোকাতে ৯৫ টাক কেজি দরেও পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর পেঁয়াজ আমদানিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল অনেকটা, সেই পণ্যের দামে হঠাৎ অস্থিরতার কারণ হিসেবে এক পাইকারি ব্যবসায়ী ভারতে টানা বৃষ্টির কথা বলেছেন।
তিনি জানাচ্ছেন, এখন চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা যাচ্ছে না। কারণ, ভারতেই এখন সংকট।
মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারের মদিনা স্টোরের বিক্রেতা আবুল কাশেম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ার কারণে খুচরা পর্যায়েও তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।
কেন এভাবে দাম বাড়ল, সেই প্রশ্নে একটি ব্যাখ্যা দিলেন কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “ভারতে টানা বৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশটিতে পেঁয়াজের সংকট তৈরি হওয়ার আভাস দিচ্ছেন সে দেশের ব্যবসায়ীরা। এর ফলে আমরা যতদ্রুত সম্ভব কিছুটা বেশি পেঁয়াজ আনতে বেশি এলসি করতে চাচ্ছি। কিন্তু তারা উল্টো আগের চেয়ে কম পেঁয়াজ পাঠাচ্ছেন।
“শুক্রবার রাতে আসা ভারতের নাসিক পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪০ টাকা। আর নিম্ন মানের একটা পেঁয়াজ আসে, ওইটা বিক্রি করছি ৪৬ টাকায়। গত সপ্তাহে এসব পেঁয়াজ ২৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।”
এই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাকে জানিয়েছেন, সে দেশের ভেলেরো সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় এবং সেগুলোর জাতও ভালো। এবার ওই এলাকায় বন্যা হওয়ায় তাদের পেঁয়াজের মজুদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ভারতের বাজারে।
নিজ দেশের সংকট এড়াতে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে বলে সে দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানতে পারার কথা জানিয়েছেন দেলোয়ার।
তিনি বলেন, “ভারত থেকে পেঁয়াজ কম পাওয়ায় আমরা দেশি পেঁয়াজের মোকাম, বিশেষ করে পাবনা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
“আমরা মতো অন্য ব্যবসায়ীরাও দেশি পেঁয়াজ কিনতে যাওয়ায় সেসব মোকাম পেয়াঁজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।”
দেশি পেঁয়াজের মজুদ পরিস্থিতিও খুব ভালো নয় বলেও তার ধারণার কথা জানান তিনি।
ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়তদার সমিতির সভাপতি হাজি মো. সাহিদ বলেন, “গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে শ্যমবাজার পাইকারি বাজারেও পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
“ভারত থেকে পেঁয়াজ পাঠানোর গতি অনেক কমে গেছে। যত দ্রুত পারা যায় ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে আনার চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে এলসি দিতে পারছে না।”
গত মে মাসের শেষের দিকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে কেজি ১০০ টাকায় উঠেছিল। আগের মাস এপ্রিলে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি বিক্রি হয় মসলা জাতীয় এ পণ্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।
বর্তমানে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি উন্মুক্ত থাকায় পেঁয়াজ আমদানি বেশি হয়েছিল। তখন দেশি পেঁয়াজের বাজারদর কম ছিল, প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল।
কৃষকরা কম দাম পেয়েছিলেন। সে জন্য পেঁয়াজ চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে আমদানি বন্ধ রেখেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পর পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে এক থেকে দুদিনের মধ্যে দেড়শ থেকে ১৮০ টাকায় উঠে যায়। এরপর সপ্তাহ না হতেই দাম বেড়ে আড়াইশ টাকায় উঠে যায় পেঁয়াজের কেজি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ওটাই ছিল পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দর। নতুন পেঁয়াজ ওঠায় পরে অবশ্য তা কমে আসে।
ওই সময় বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মান ভালো না হওয়ায় অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিলেন।
এবার পেঁয়াজের দামের লাগাম টেনে ধরতে দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত গত ৪ জুন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। পরের দিন থেকেই পাশের দেশ ভারতের পেঁয়াজ বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে দেশে ঢুকতে শুরু করেছে।
ওই সময় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবসহ ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়।
গত রমজান মাসের পর থেকে দেশের বাজারে হুহু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। কয়েক দফা বেড়ে দেশের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকা দামে বিক্রি হতে থাকে, পাইকারি বাজারে যা ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত।
গত বছর চাহিদার চেয়ে অধিক আমদানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন পেঁয়াজচাষিরা। তাই চাষিদের পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত করতে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল সরকার।
টিসিবির খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, গত কয়েক দিনে টানা বাড়তে বাড়তে শনিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে এক হালি ফার্মের মুরগির ডিম ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি ডজনের দাম ১৮০ টাকা; প্রতিটির দাম ১৫ টাকা।
কমেন্ট