সিন্ডিকেট ভাঙা অনেক কঠিন: কৃষিমন্ত্রী
সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, সোমবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতিকেজি ভালো দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়।
রোববার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৮৫ টাকায়। আমদানি করা পেঁয়াজের দর ছিল ৬৫ টাকা। এ মাস আগে ২১ জুলাই দেশি পেঁয়াজের দর ছিল ৬৫ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৫০ টাকায়।
ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই শুল্ক শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর এই শুল্ক বহাল থাকবে।
বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম এমনিতেই ঊর্ধ্বমূখী ছিল। ভারত শুল্ক আরোপ করায় তা আরও বেড়ে গেছে। বাড়তি শুল্ক আরোপের আমদানি করা পেঁয়াজ এখনও দেশে আসেনি। এর পরও খুচরা বাজারে কেজিতে দাম দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে।
বছরের পর বছর ধরে বাজারে একই চিত্র দেখা গেলেও সরকার কখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ইচ্ছা করলেই বাজার মনিটরিং করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। আসলে চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করে। সরবরাহ বেশি হলে দাম অটো কমবে, এটাই হলো মূল কথা।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, “আপনারা যতই বলেন, আমরা কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছি না… আসলে সিন্ডিকেট ভাঙা অনেক কঠিন।”
সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এ কথা বলেন আব্দুর রাজ্জাক।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর সরকারের সিদ্ধান্ত জানাতে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসেন মন্ত্রী। তিনি জানান, এখন থেকে চীন, জাপান, ইরান, মিশর ও তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা অনেক কঠিন। ইচ্ছা করলেই মনিটরিং করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দাম নির্ভর করবে সরবরাহের ওপর।”
গত ২৬ জুন একই ধরনের একটি বক্তব্য দিয়ে জাতীয় সংসদে তোপের মুখে পড়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তো বটেই, আওয়ামী লীগের শরিক দলের পক্ষ থেকেও তার পদত্যাগের দাবি ওঠে সে সময়।
সেদিন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “বাজারে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলো একসাথে অনেক বেশি ব্যবসা করে। আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার- আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম। সেটা হয়ত করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটা সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে। এজন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করি।”
নিত্যপণ্যের দর নিয়ে বছর দুয়েক ধরেই মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ স্পষ্ট। নানা সময় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ স্পষ্ট।
চলতি বছর ঈদুল ফিতরের আগে ব্রয়লার মুরগির বাজার করপোরেট কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল বলে খোদ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বক্তব্য আসে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ডিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। গত বছরের শেষ দিকে একদফা এবং চলতি মাসে দ্বিতীয় দফায় ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৮০ টাকা উঠে যাওয়ার পর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নামার পর দাম কিছুটা কমেছে। দুইবারই স্পষ্ট হয়, দাম কৃত্তিমভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ানো হয়েছে, যা প্রতিযোগিতা আইনের লঙ্ঘন।
অবশ্য পেঁয়াজের দর নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, “বাজার মনিটরিং করতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে শক্তভাবে। এক্ষেত্রে সকলকে নিয়ে আমরা চেষ্টা করব বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করার।”
বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহারে ভারতকে অনুরোধ
মন্ত্রী জানান, তারা বাংলাদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে যেন শুল্ক অব্যাহতি দিতে ভারতকে অনুরোধ করেছেন।
তিনি বলেন, “ভারতের এই পদক্ষেপের পর পেঁয়াজের দাম কীভাবে সামলাব, এ বিষয়ে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে আলাপ করেছি।
“আমরা বলেছি, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে কেন অব্যাহতি দেন না? এতে আপনাদের বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না- এই অনুরোধ করেছি।
“তারা বলেছেন, ‘আমরা এই বিষয়টি বিবেচনা করছি’। দ্রুত এই বিষয়টি প্রস্তাব আকারে মন্ত্রীদের গ্রুপে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তারা বলেছে, বাংলাদেশকে বিশেষ বিবেচনায় দেখবে।”
ভারতের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, “পেঁয়াজের এই যে জাতীয় সমস্যা- যে বছর উৎপাদন কম হয়, দাম বেড়ে যায়। আর যখন বেশি দাম বাড়ে, ভারতে এর ওপর রেস্ট্রিকশন দেয়৷”
ভারত বাড়তি শুল্কারোপ করার পরেও পেঁয়াজের দর খুব বেশি বাড়বে না বলে আশা করছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন,
“চাষিদের ঘরে অন্য বছরের তুলনায় পেঁয়াজ একটু বেশি আছে। দাম বাড়বে, তবে আকাশচুম্বী হবে না বলে ধারণা করছি।”
অন্য দেশ থেকে কালই আমদানি করা যাবে
এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “এখন থেকে কেউ ভারত না; চায়না, জাপান, ইরান বা যে কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে চায়, আমরা তাদেরকেই অনুমতি দেব।”
কবে থেকে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবে- এ প্রশ্নে জবাব এল, “আমদানি তো কাল থেকেই হতে পারে। যারা আমদানি করে, তারা কাল থেকেই করবে- অসুবিধা নাই। তবে ব্যবসায়ীরা চিন্তা করে লাভ হবে কি না।”
পেঁয়াজ নিয়ে সমস্যা ‘উৎপাদন নয়, সংরক্ষণে’
দেশে এখন প্রতি হেক্টরে ২০ টন পর্যন্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয় জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, “পেঁয়াজের মূল মৌসুম হল মার্চের শেষে ও এপ্রিলের প্রথম দিকে। সে সময় দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, এটা হলো আমাদের সমস্যা।
“পেঁয়াজ যেহেতু পচনশীল, তাই বেশি ঘরে থাকলে নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যদি পেঁয়াজ ঠিকমত সংরক্ষণ করতে পারতাম, তাহলে পেঁয়াজ নিয়ে কোনো সমস্যা হত না।
“বড় সমস্যা হচ্ছে পেঁয়াজ গুদামে রাখা যায় না। সেজন্য আমাদের প্রায় প্রতি বছর পেঁয়াজ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।”
পেঁয়াজ চাষ নিয়ে কৃষকের মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “গত বছর দাম কম ছিল, ফলে চাষিরা এ বছর আবাদ করতে পারে নাই। এজন্য এবছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন কম হয়েছে।”
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “চাষিরা যাতে ভালো দাম পায়, এজন্য প্রথম দিকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে চাষিরা ভালো দাম পেয়েছে। এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে আমদানি না করলে দেশি পেঁয়াজ কমে যাচ্ছে এবং দাম আস্তে আস্তে বাড়ছিল।
“সেই প্রেক্ষিতে আমরা আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমরা ১৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য আইপিও দিয়েছি। কিন্তু এসেছে মাত্র ৩ লাখ টন।”
কমেন্ট